যাকাত ও ট্যাক্সের মধ্যে পার্থক্য কি? বর্তমানে মোটা অংকের অর্থ সরকার আরোপিত ট্যাক্সের পিছনে ব্যয় হয়। যা যাকাতের চেয়ে অনেক বেশী হয়ে যায়। এক্ষণে ট্যাক্স দিলে যাকাতের ফরযিয়াত আদায় হবে কি?

যাকাত ও ট্যাক্সের মধ্যে পার্থক্য কি? বর্তমানে মোটা অংকের অর্থ সরকার আরোপিত ট্যাক্সের পিছনে ব্যয় হয়। যা যাকাতের চেয়ে অনেক বেশী হয়ে যায়। এক্ষণে ট্যাক্স দিলে যাকাতের ফরযিয়াত আদায় হবে কি?

যাকাত ও ট্যাক্সের মধ্যে পার্থক্য কি? বর্তমানে মোটা অংকের অর্থ সরকার আরোপিত ট্যাক্সের পিছনে ব্যয় হয়। যা যাকাতের চেয়ে অনেক বেশী হয়ে যায়। এক্ষণে ট্যাক্স দিলে যাকাতের ফরযিয়াত আদায় হবে কি?

উত্তর : যাকাত ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম। যা আল্লাহর ওয়াস্তে প্রদান করলে সম্পদ পবিত্র হয় এবং বৃদ্ধি পায় (তওবা ৯/১০৩; বাক্বারাহ ২/২৭৬)

এটি প্রত্যেক মুমিনের জন্য আর্থিক ফরয ইবাদত। অন্যদিকে ট্যাক্স হ’ল সরকারী কর। এর সাথে যাকাতের কোন সম্পর্ক নেই। রাষ্ট্রকে যে পরিমাণ ট্যাক্সই দেওয়া হোক না কেন, তাতে যাকাত আদায় হবে না। বরং ট্যাক্স পরিশোধের পর সম্পদ নিছাব পরিমাণ থাকলে এবং তা এক বছর অতিবাহিত হ’লে তাতে যাকাত দিতে হবে (ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা ৯/২৮৫)

জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে ইহূদী, খ্রিষ্টান ও হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থসমূহ পাঠ করা যাবে কি?

জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে ইহূদী, খ্রিষ্টান ও হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থসমূহ পাঠ করা যাবে কি?

জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে ইহূদী, খ্রিষ্টান ও হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থসমূহ পাঠ করা যাবে কি?

উত্তর : পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে পূর্বের সমস্ত আসমানী কিতাবের বিধান রহিত হয়ে গেছে (আলে ইমরান ৩/৮৫)

তাই জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে কুরআন ব্যতীত অন্য কোন ধর্মগ্রন্থ পাঠ করা জায়েয নয়। জাবের (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন যে, একদিন যখন ওমর (রাঃ) তাঁর কাছে এসে বললেন, আমরা ইহূদীদের নিকটে তাদের অনেক পুরানো ধর্মীয় কাহিনী শুনি, যা আমাদের নিকটে চমৎকার বোধ হয়, অতএব তার কিছু কিছু লিখে রাখার জন্য আপনি আমাদের অনুমতি দিবেন কি? তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমরা কি দিকভ্রান্ত হয়েছ, যেমন ইহূদী-নাছারারা দিকভ্রান্ত হয়েছে? অথচ আমি তোমাদের কাছে এসেছি উজ্জ্বল ও পরিচ্ছন্ন দ্বীন নিয়ে। যদি আজকে মূসাও বেঁচে থাকতেন, তাহ’লে তাঁর পক্ষেও আমার অনুসরণ ব্যতীত গত্যন্তর থাকতো না’ (আহমাদ হা/১৫১৫৬; মিশকাত হা/১৭৭, সনদ হাসান)।

তবে অমুসলিমদের ইসলামবিরোধী বক্তব্য সমূহের জবাবদানের উদ্দেশ্যে শরী‘আত অভিজ্ঞ আলেমদের জন্য এগুলি পাঠ করা সাময়িকভাবে জায়েয (আলে ইমরান ৩/১৯৩; বুখারী হা/৪৫৫৬; ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৪/১০৯-১০)

স্বামী-স্ত্রী কি একে অপরের যৌনাঙ্গে মুখ দিতে পারে?

স্বামী-স্ত্রী একে অপরের যৌনাঙ্গে মুখ দিতে পারে?

স্বামী-স্ত্রী কি একে অপরের যৌনাঙ্গে মুখ দিতে পারে?

দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর আনন্দ-বিনোদনের ক্ষেত্রে কী কী কাজ করা হারাম তা আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন। সেগুলো হলো দুটি:

১) ঋতুস্রাব বা বাচ্চা প্রসবোত্তর স্রাব চলাকালীন সময় স্ত্রী সহবাস করা।
২) স্ত্রীর পায়ুপথ ব্যবহার করা।

এই দুটি বিষয় ছাড়া পারস্পরে যেভাবে খুশি সেভাবে আনন্দ উপভোগ করতে পারে। কোন কিছুকে হারাম বলার সুযোগ নাই।
আল্লাহ তাআলা বলেন:

نِسَاؤُكُمْ حَرْثٌ لَكُمْ فَأْتُوا حَرْثَكُمْ أَنَّىٰ شِئْتُمْ ۖ وَقَدِّمُوا لِأَنْفُسِكُمْ ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ مُلَاقُوهُ ۗ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ

“তোমাদের স্ত্রীরা হলো তোমাদের জন্য শস্য ক্ষেত্র। তোমরা যেভাবে ইচ্ছা তাদেরকে ব্যবহার কর।” (Sura Al-Baqarah, Ayah 223)

কেননা বিয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো, স্বামী-স্ত্রী বৈধভাবে একে অপর থেকে আনন্দ উপভোগ করা এবং এর মাধ্যমে হারাম পন্থা থেকে নিজের লজ্জাস্থান এবং চক্ষু হেফাজত করা।

যদিও কেউ কেউ বলতে চেয়েছেন যে, মুখে যেহেতু আল্লাহর জিকির করা হয় এবং লজ্জাস্থান দিয়ে নাপাকি বের হয় তাই স্বামী-স্ত্রী একে অপরের যৌনাঙ্গে মুখ লাগানো ঠিক নয়। আমরা বলব, কোনটা ঠিক আর কোনটা ঠিক নয় তা নির্ধারণকারী একমাত্র আল্লাহ এবং তার রাসুল। এর বাইরে আমরা কোন কিছুকে হারাম বলার অধিকার রাখি না। তবে অনেক আলেমের মতে, সর্বোচ্চ বলা যেতে পারে, এটি সুস্থ রুচিবোধ ও উন্নত চরিত্র বিরোধী এবং আদব পরিপন্থী কাজ কিন্তু তা হারাম বা এ জন্য গুনাহগার হতে হবে-এমন কোন কথা বলা ঠিক নয়।

সুতরাং সুস্থ রুচিবোধ ও অনুত্তম হওয়ার দিক বিবেচনায় এ থেকে বিরত থাকা ভালো। তবে যদি লজ্জাস্থান থেকে নির্গত নাপাক বস্তু গিলে ফেলা হয় তাহলে তা হারাম।
(সৌদি বড় আলেমদের ফতোয়ার সার সংক্ষেপ)

 
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, KSA

আত্মশুদ্ধি

download (4).png

আল্লাহ রাববুল আলামীন মানুষকে তিনটি বিশেষ উপাদান দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। সেগুলো হল জ্ঞান, দেহ এবং আত্মা। জ্ঞানকে দিকনির্দেশনা দেয় ঈমান, দেহের কল্যাণ সাধন করে ইসলাম এবং আত্মার পরিশুদ্ধি নিশ্চিত করে ইহসান। একজন মানুষের পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠা এ উপাদানগুলোর সুষম সমন্বয়ের উপর নির্ভরশীল। এগুলোর মধ্যে সর্বাধিক কঠিন ও আয়াসসাধ্য বিষয় হলো ইহসান। আত্মার পবিত্রতা অর্জনের সাথেই ইহসান সম্পৃক্ত।

আত্মার স্বরূপ নিয়ে আল্লাহ রাববুল আলামীন এতটুকুই বলেছেন যে, এটি মহান আল্লাহর একটি হুকুম। স্রষ্টার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত এই তাৎপর্যময় হুকুমের পবিত্রতা রক্ষা করাই মানুষের প্রধান কর্তব্য। এই কর্তব্য পালনই মানুষকে পূর্ণতার পথে নিয়ে যেতে পারে। এজন্য ব্যক্তির মাঝে ‘তাযকিয়াতুন নফস’ বা আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি সাধন করা ইসলামের মৌলিক লক্ষ্য। ইসলামের সকল নিয়মতান্ত্রিক ইবাদতসমূহ একই লক্ষ্যে নিবেদিত। বলা যায় আত্মশুদ্ধিতার উপরই নির্ভর করে মানুষের যাবতীয় কার্যক্রম ও তার ফলাফল।

মূলতঃ মানুষের অন্তর্জগত এমন একটি বিশাল জগত যার ব্যাপকতা দৃশ্যমান জগতের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। আবার এটি এমন এক স্থান একমাত্র আল্লাহ ছাড়া যেখানে অন্য কারোরই প্রবেশাধিকার নেই। মানুষ তার প্রতিটি কাজ কি উদ্দেশ্যে করছে তার খবর কেবল তার আত্মাই জানে। আবার সমস্ত খবর সে বাইরে চেপে যেতে পারলেও নিজের অন্তরের কাছে সে কিছুই লুকাতে পারে না। সেজন্য অন্তরের এই গভীরতম প্রদেশটি মানুষের সবচেয়ে নিকটবর্তী ও সর্বাধিক আপন। এ স্থানের সাথে প্রতারণা করার সাধ্য কারো নেই। পৃথিবীতে মানুষের সবচেয়ে বিশ্বস্ত অদৃশ্য ও অনুভূতিস্তরের এই স্থানটির গতি-প্রকৃতির উপরই নির্ভর করে তার বিস্তীর্ণ কর্মজগত। এজন্য আল্লাহ রাববুল আলামীন পবিত্র কুরআনে বার বার অন্তরাত্মাকে পরিশুদ্ধ করার জন্য যেমন তাকিদ দিয়েছেন তেমনি এটা অর্জনের উপরই মানুষের সফলতা, ব্যর্থতাকে নির্ভরশীল করে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন,  قَدْ أَفْلَحَ مَن زَكَّاهَا وَقَدْ خَابَ مَن دَسَّاهَا ‘যে ব্যক্তি নিজেকে পরিশুদ্ধ করল সে-ই সফল, আর ব্যর্থ সে-ই যে নিজের অন্তঃকরণকে কলুষিত করল’ (শামস্ ৯-১০)

রাসূল (ছাঃ) বলেন, ألا وإنَّ في الجَسَدِ مُضغَةً إذا صلَحَتْ صلَحَ الجَسَدُ كلُّه ، وإذَا فَسَدَت فسَدَ الجَسَدُ كلُّه ، ألا وهِيَ القَلبُ‘সাবধান! মানুষের দেহের অভ্যন্তরে একটি পিন্ড রয়েছে, যদি তা পরিশুদ্ধ হয় তবে সমস্ত দেহই পরিশুদ্ধ হয়; আর যদি তা বিকৃত হয়ে যায় তবে সমস্ত দেহই বিকৃত হয়ে যায়। সেটা হল  কলব বা আত্মা’। (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/ ২৭৬২)

পবিত্র কুরআনে মানুষের নফস বা অন্তরের তিন ধরনের প্রকৃতি উল্লেখিত হয়েছে। ১. মুত্বমায়িন্নাহ (প্রশান্ত আত্মা): সে অন্তর যে তার প্রভুর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে এবং তাঁর আনুগত্যেই সুস্থির হয়েছে। যে আল্লাহর দাসত্বে, তাঁর স্মরণে ও ভালবাসায় প্রশান্তি অর্জন করেছে। বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবকিছুই তাঁর উপর সমর্পণ করেছে। তাঁর ভবিতব্যকে (কাযা ও কদর) অম্লান বদনে গ্রহণ করেছে। তাঁর সাক্ষাৎ ও প্রতিশ্রুতির উপর পূর্ণ আস্থা রেখেছে এবং এক মুহূর্তের জন্যও যে অন্তর প্রভুর যিম্মাদারী থেকে বিচ্যুৎ হয় না। ২. লাওয়ামাহ (ভৎর্সনাকারী আত্মা): যে অন্তর মানুষকে তার কর্তব্যচ্যুতির জন্য নিরন্তর ভৎর্সনা করে ও ধিক্কার জানায়। ৩. আম্মারাহ (কুমন্ত্রণাদানকারী আত্মা): যে আত্মা মানুষকে আল্লাহ ও তার রাসূলের অবাধ্যতা ও  কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করার জন্য প্ররোচণা দেয়। যে তার অনুগত হয়ে খারাপ পথে পা বাড়ায় তাকে সে যাবতীয় অকল্যাণ ও হীনকর কাজে প্রলুব্ধ করে। অন্তরের এরূপ প্রকৃতি মূর্খতা ও যুলুম থেকে সৃষ্ট। কেননা মানবাত্মা মূলতঃ অজ্ঞ ও অন্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থাতেই পৃথিবীতে আগমন করেছে। আল্লাহ ইলহামের মাধ্যমে তাতে জ্ঞান ও ন্যায়বিচারের গুণাবলী সংযুক্ত করে দিয়েছেন। যদি আল্লাহ বিশ্বাসীদের প্রতি অনুগ্রহ না করতেন তবে কোন আত্মাই পরিশুদ্ধ হত না। তিনি যার জন্য কল্যাণের ইচ্ছা পোষণ করেছেন তাকে পরিশুদ্ধ ইচ্ছাশক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গি দান করেছেন। আর যার প্রতি কল্যাণের ইচ্ছা করেননি তাকে তার অবস্থানে তথা মূর্খতা ও পাপাচারের উপর ছেড়ে দিয়েছেন (নূর ২১)

আল্লাহ বলেন, ‘হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি তোমার প্রতিপালকের কাছে ফিরে এসো সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। আমার বান্দাদের মধ্যে   অন্তর্ভুক্ত হও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর’ (ফাজর ২৭)

আত্মশুদ্ধির পরিচয় ও প্রকারভেদ :

আত্মশুদ্ধির বিষয়টি দুইভাবে ব্যাখ্যা দেয়া যায়। ১. নঞর্থক: যাবতীয় পাপ, অন্যায় ও অপবিত্র কাজ থেকে মুক্ত হওয়া অর্থাৎ যাবতীয় অসদ্গুণাবলী বর্জন করা। অসদ্গুণাবলী হলো- শিরক, রিয়া, অহংকার, আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা, হিংসা, ঘৃণা, কৃপণতা, ক্রোধ, গীবত, কুধারণা, দুনিয়ার প্রতি মোহ, আখেরাতের উপর দুনিয়াকে প্রাধান্য দেওয়া, জীবনের প্রতি অসচেতনতা, অর্থহীন কাজ করা, অনধিকার চর্চা প্রভৃতি।

২. সদর্থক: উত্তম গুণাবলী দ্বারা আত্মার উন্নতি সাধন করা অর্থাৎ প্রশংসনীয় গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে পরিত্যাগকৃত অসদ্গুণাবলীর শূন্যস্থান পূরণ করা। সদ্গুণাবলী হল তাওহীদ, ইখলাছ, ধৈর্যশীলতা, তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা, তওবা, শুকর বা কৃতজ্ঞতা, আল্লাহভীতি, আশাবাদিতা, লজ্জাশীলতা, বিনয়-নম্রতা, মানুষের সাথে উত্তম আচরণ প্রদর্শন, পরস্পরকে শ্রদ্ধা ও স্নেহ, মানুষের প্রতি দয়া, ভালবাসা ও সহানুভূতি প্রদর্শন, ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ, পরোপকার প্রভৃতি।

পবিত্র কুরআনে দু’টি অর্থেই ‘তাযকিয়াতুন নফস’ শব্দটির ব্যবহার এসেছে। তাযকিয়াতুন নাফস সম্পর্কে আরেকটি সংজ্ঞা দেওয়া যায় এভাবে যে, অন্তরকে শিরক ও তার যাবতীয় শাখা-প্রশাখা থেকে মুক্ত রাখা, তাওহীদ ও তার সমস্ত শাখা-প্রশাখাকে অন্তরে প্রতিষ্ঠিত করা, আল্লাহর সুন্দরতম নামগুলোর গুণে গুণান্বিত হওয়া, প্রভুত্বের যাবতীয় উপকরণকে বর্জন করে পূর্ণাঙ্গভাবে এক আল্লাহর দাসত্ব করা এবং প্রতিটি বিষয়ে শেষ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর দেখানো পথ পুংখানুপুংখ অনুসরণ করা।

আত্মশুদ্ধির গুরুত্ব :

  1. 1.  আল্লাহ রাববুল আলামীন পবিত্র কুরআনে আত্মশুদ্ধি অর্জনকারীর সফলতার নিশ্চয়তা ও তা পরিত্যাগকারীর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ব্যাপারে এগারো বার কসম করেছেন (সূরা শামস্)।
  2. 2. আত্মা মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রুতে পরিণত হয় যখন সে তাকে পাপাচার ও সীমালংঘনের দিকে আহবান করে। কেননা এই  অপরিশুদ্ধ, পাপাচারী, ব্যাধিগ্রস্ত অন্তর মানুষকে আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। এজন্য রাসূল (ছাঃ) অন্তরের অনিষ্ট থেকে অধিক পরিত্রাণ চাইতেন-اللهمَّ آتِ نفسي تَقْوَاهَا ، وَزَكِّهَا أَنْتَ خَيْرُ مَنْ زَكَّاهَا ، أَنْتَ وَلِيُّهَا وَمَوْلاَهَا ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার অন্তরকে আত্মরক্ষার ক্ষমতা দাও এবং তাকে পরিশুদ্ধ কর। তুমিই অন্তরের সর্বোত্তম পরিশোধনকারী এবং তুমিই তার অভিভাবক ও প্রতিপালক’ (মুসলিম, মিশকাত হা/২৪৬০)
  3. 3. আত্মশুদ্ধি অর্জন জান্নাত লাভের উপায়। আল্লাহ বলেন, وأما من خاف مقام ربه ونهى النفس عن الهوى فإن الجنة هي المأوى ‘যে ব্যক্তি তার প্রভুর সামনে উপস্থিত হওয়াকে ভয় করে এবং নিজের অন্তরকে কুপ্রবৃত্তি থেকে দূরে রাখে, জান্নাতই হবে তার জন্য চূড়ান্ত আবাসস্থল’ (নাযি‘আত ৪০)
  4. 4.  আত্মা হল ঈমানের সংরক্ষণস্থল। আর ঈমান হল মানুষের সর্বাধিক মূল্যবান সম্পদ। যদি ঈমান না থাকে তাহ’লে মানুষের সমগ্র জীবনই বৃথা। তাই এ সম্পদকে সুরক্ষা ও তার পরিবৃদ্ধি সাধনের জন্য অন্তরজগতের পরিশুদ্ধি নিশ্চিত করতে হয়।
  5. 5.  মুসলিম উম্মত আক্বীদা-বিশ্বাস, ইবাদত ও ব্যবহারিক প্রতিটি ক্ষেত্রে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার ধারক-বাহক। তাই কোন ধরনের অকল্যাণকর উপাদান যেন তার অন্তরকে বক্র করে না ফেলে বা সংকীর্ণতায় নিক্ষেপ না করে সেজন্য তাকে সদা সতর্ক থাকতে হয়। রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, কোন ব্যক্তি সর্বোত্তম? তিনি বলেন, ঐ ব্যক্তিই সর্বোত্তম যে সত্যবাদী ও পরিচ্ছন্ন অন্তরের অধিকারী, যা পাপাচার, অবিচার, প্রতারণা ও হিংসা থেকে মুক্ত (ইবনে মাজাহ হা/৪২১৬, সনদ ছহীহ)
  6. 6.          তাক্বদীরের উপর সন্তুষ্ট ও আস্থাবান আত্মা মানুষের জন্য দুনিয়াবী জীবনে প্রশান্তি অর্জন ও জটিলতা মুক্তির কারণ এবং পরকালীন জীবনে গণীমতস্বরূপ। যে ব্যক্তি কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই নেক আমল করে সে ব্যক্তি তার সহগামীদের জন্য নিখাদ ভালবাসা ছাড়া অন্য কিছু বহন করতে পারে না। এরূপ নির্ভার, প্রশান্ত, বিদ্বেষমুক্ত আত্মা এমন একটি নে‘আমত যা আল্লাহ্ জান্নাতীদেরকে দান করবেন(হিজর ৪৭)
  7. 7.  মানুষ সবসময় পূর্ণতার আকাংখী। এই পরিপূর্ণতা অর্জনের জন্য আত্মশুদ্ধি অপরিহার্য। মানুষ নিজের শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য যেভাবে নিয়মিত খাদ্য গ্রহণ করে ও যাবতীয় অনিষ্ট থেকে তাকে   রক্ষা করার জন্য সার্বক্ষণিক পরিচর্যা করে, ঠিক তেমনি অন্তরকে পবিত্র রাখার জন্য নিয়মিত খাদ্য প্রদান ও পরিচর্যা প্রয়োজন। ঈমান ও নেক আমল হল  সেই খাদ্য। শরীর যেমন খাদ্য পেয়ে শক্তি অর্জন করে তেমনি অন্তরও নেক আমলের মাধ্যমে শক্তি অর্জন করে।

সাইয়েদ কুতুব বলেন, ‘মানুষ একই সাথে মাটির তৈরী ও আল্লাহর নির্দেশপ্রাপ্ত সত্তা। তাই তার মধ্যে পাপ-পুণ্য, কল্যাণ-অকল্যাণ দুই ধারার প্রকৃতি সমানভাবে ক্রিয়াশীল। এ কারণে সে কোনটি কল্যাণকর, কোনটি অকল্যাণকর তা বাছাই করে যেকোন দিকে নিজেকে পরিচালনা করতে সক্ষম। আল্লাহ মানুষের মধ্যে এই ক্ষমতাকে সহজাত করে দিয়েছেন। যাকে তিনি কুরআনে কখনো ‘ইলহাম’ দ্বারা প্রকাশ করেছেন, যেমন- ‘(অন্তরকে) তিনি অসৎকর্ম ও সৎকর্ম সম্পর্কে জ্ঞান দান করেছেন’ (শামস ৮-৯)। কখনো প্রকাশ করেছেন হিদায়াত দ্বারা, যেমন- ‘আমি তাকে দু’টি পথ প্রদর্শন করেছি’ (বালাদ ১০)। এই সহজাত দু’টি প্রবণতার সাথে মানুষের অন্তরাত্মায় আরো একটি বোধগম্য ও প্রভাবশালী শক্তি রয়েছে যার নাম ‘বিবেক’। যে ব্যক্তি এই বিবেকশক্তিকে অন্তরাত্মার পরিশুদ্ধিতে নিয়োজিত করে, নেক আমলের মাধ্যমে তার প্রবৃদ্ধি সাধন করে এবং অন্যায়-অকল্যাণের বিরুদ্ধে তাকে বিজয়ী করতে পারে সে-ই সফল; আর যে ব্যক্তি বিবেকশক্তির প্রতি অবিচার করে এবং তাকে দুর্বল করে ফেলে সে ব্যক্তি ব্যর্থ’(ফী যিলালিল কুরআন, পৃঃ ৮/৪৮)

আত্মশুদ্ধি অর্জনের উপায় :

নিয়মিত পদক্ষেপ :

  1. 1.  হালাল-হারাম সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান অর্জন করা: জীবনের সর্বক্ষেত্রে হালাল-হারাম বাছাই করে চলার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করতে হবে। আত্মাকে সর্বতোভাবে পরিশুদ্ধ রাখার জন্য যা অত্যাবশ্যক। যাবতীয় বদগুণাবলী থেকে নিজেকে পরহেয করে রাখতে হবে। নিয়মিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলে এক সময় তা অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে মানুষের স্বভাবগত হয়ে পড়ে। আল্লাহ বলেন, ‘যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথে আছেন’ (আনকাবূত ৬৯)
  2. 2. আত্মাকে বিভিন্ন উত্তম চরিত্র দ্বারা পরিমার্জন ও পরিশোধন করা : নিয়মিতভাবে সৎগুণাবলী অনুশীলনে তা সহজাত অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়।
  3. 3. ফরয ইবাদতসমূহ নিয়মিত আদায় করা : কেননা ফরয ইবাদত আল্লাহর আনুগত্যের সর্বোত্তম বহিঃপ্রকাশ যার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর সর্বাধিক নিকটবর্তী হয়। রাসূল (ছাঃ) হাদীছে কুদসীতে উল্লেখ করেছেন যে, আল্লাহ বলেন, وما تقرب إليّ عبدي بشيء أحب  إلي مما افترضتهُ عليه ‘বান্দা আমার নিকটতর হ’তে পারে না এমন কোন আমল দ্বারা যা আমার নিকট অধিক প্রিয়তর হ’তে পারে আমি যেটা ফরয করেছি তা (ছালাত)অপেক্ষা’ (বুখারী, মিশকাত হা/২২৬৬)
  4. 4.  অধিকমাত্রায় নফল ইবাদত করা : কেননা নফল ইবাদতকারী ব্যক্তিকেও আল্লাহ তার নৈকট্যের সুসংবাদ দিয়েছেন (ঐ)। নফল আমলের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি অধিক বিনয়াবনতভাব প্রকাশ পায়, যা আত্মার পরিশুদ্ধিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে।
  5. 5.  পবিত্র কুরআন পাঠ করা ও তাতে চিন্তা-গবেষণা নিয়োজিত করা : কুরআন পাঠ অন্তরের কালিমা দূর করে দেয়। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বার বার এই কুরআনকে গবেষণা করার জন্য আহবান জানিয়েছেন। আত্মার প্রশান্তিতে কুরআন তেলাওয়াতের ভূমিকা যে কত অপরিসীম পবিত্র কুরআনে ও বহু হাদীছে তা বর্ণিত হয়েছে।
  6. 6.          সৎসঙ্গ নিশ্চিত করা : সৎস্বভাববিশিষ্ট ব্যক্তির সংসর্গে থাকলে অজ্ঞাতসারেই তার সদগুণ নিজের অন্তরে প্রবেশ করে। এজন্য রাসূল (ছাঃ) সৎ সঙ্গী নির্বাচনের জন্য জোর তাকীদ দিয়েছেন।   

বিশেষ পদক্ষেপ : 

  1. 1.তওবা : আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশের প্রথম পদক্ষেপ হল  তওবা করা। তওবার মাধ্যমেই মানুষ পাপ বর্জন করে পুণ্য অর্জনের তৃপ্তি অনুভব করতে পারে। আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ তোমরা সকলে আল্লাহর সমীপে তওবা করো যেন তোমরা কৃতকার্য হ’তে পার’ (নূর ৩১)। তিনি আরো বলেন, ‘হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট প্রকৃতভাবে তওবা করো; আশা করা যায় আল্লাহ তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন’ (তাহরীম ৮)
  2. 2.   আল্লাহর স্মরণ করা ও ক্ষমা প্রার্থনা করা : আল্লাহ বলেন, وَمَنْ يَعْشُ عَنْ ذِكْرِ الرَّحْمَنِ نُقَيِّضْ لَهُ شَيْطَانًا فَهُوَ لَهُ قَرِينٌ ‘যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর স্মরণ থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়, আমি তার জন্য এক শয়তানকে নিয়োজিত করে দেই, অতঃপর সে-ই হয় তার সঙ্গী’ (যুখরুফ ৩৬)। আল্লাহ্ বলেন, ‘তারা (মু’মিনরা) কখনো পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়লে অথবা অন্যায় কাজ করে নিজের আত্মার উপরে যুলুম করে ফেললে আল্লাহ্কে স্মরণ করে এবং নিজের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে’ (আলে ইমরান ১৩৫)। ‘(মুমিনরা) রাত্রের শেষ প্রহরে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে’ (আলে ইমরান ১৭)। ‘কেউ যদি পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়ে কিংবা নিজের উপর যুলুম করে ফেলে অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় সে আল্লাহ্কে ক্ষমাশীল ও দয়াময় হিসাবেই পাবে’ (নিসা ১১০)
  3. 3.   প্রবৃত্তির কঠোর বিরুদ্ধাচরণ করা ও অসৎচিন্তাকে কোনভাবেই প্রশ্রয় না দেওয়া : আত্মাকে পরিশুদ্ধ করতে ক্রমাগতভাবে প্রবৃত্তির বিরুদ্ধাচরণ করতে হয়। কেননা প্রবৃত্তি মানুষকে শিথিলতা ও অবাধ্যতায় প্ররোচিত করে। আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি আত্মাকে কু-প্রবৃত্তি হ’তে অবদমিত রাখল তার বাসস্থান হল  জান্নাত’ (নাযি‘আত ৪০)। ইবনুল কাইয়্যিম বলেন, ‘এই অনুশীলন করার সময় তাকে জানতে হবে যে, আজ সে যতবার এই প্রচেষ্টা চালাচ্ছে আগামী দিন তা তার জন্য ততধিক স্বস্তির কারণ হতে যাচ্ছে আর যতবার সে শিথিল হচ্ছে তা আগামী দিন তার জন্য ততধিক কঠিনভাবে ধৃত হওয়ার উপলক্ষ্য হতে যাচ্ছে। তাকে মনে রাখতে হবে যে, তার কর্ম থেকে অর্জিত মুনাফা হল  জান্নাতুল ফেরদাউসের সীমাহীন প্রশান্তিপূর্ণ আবাসস্থল এবং মহান প্রভুকে দর্শনের সৌভাগ্য অর্জন। আর লোকসান হওয়ার অর্থ নিশ্চিত জাহান্নামে প্রবেশ ও প্রভুর দর্শন থেকে বঞ্চিত হওয়া। যে ব্যক্তি এই মানসিকতায় দৃঢ়প্রত্যয়ী হতে পারে, পার্থিব জীবনের হিসাব তার নিকট গৌণ হয়ে পড়ে। অতএব একজন প্রকৃত মু’মিনের কর্তব্য হল  আত্মসমালোচনায় গাফলতি না করা এবং অন্তরের গতি-প্রকৃতি ও প্রতিটি পদক্ষেপকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। কেননা আত্মা এমন এক অমূল্য সম্পদ যা দ্বারা মানুষ সেই গুপ্তধনের অধিকারী হ’তে পারে যা অনন্তকাল ধরে কখনই নিঃশেষ হয় না। এই অমূল্য আত্মাকে যারা কলুষময় করে ধ্বংস করে ফেলে এবং তুচ্ছ মূল্যের বিনিময়ে তার জন্য অবর্ণনীয় ক্ষতি ডেকে আনে সে ব্যক্তি পৃথিবীর সর্বাধিক নির্বোধ ও বিচারজ্ঞানহীন ব্যক্তি। শেষ বিচারের দিনে সে তার পরিণতি জানতে পারবে। আল্লাহ বলেন, ‘সেদিন প্রত্যেক আত্মা যা সৎকর্ম করেছে ও বদকর্ম করেছে তা উপস্থিত পাবে’(আলে ইমরান ৩০)(ইগাছাতুল লাহফান মিন মাছায়িদিশ শয়তান ১/৮৫ পৃঃ)
  4. 4.   আল্লাহর আনুগত্যে থাকার জন্য নিজেকে ধমক দেওয়া : অন্যায় কাজের জন্য অন্তরকে ভৎর্সনা ও তিরস্কার করলে নাফসে আম্মারাহ (কুপ্রবৃত্তি) নাফসে মুতমায়িন্নায় (প্রশান্ত আত্মা) পরিণত হয়। অন্যকে উপদেশ দানের পূর্বে নিজেকে বারবার উপদেশ দিতে হবে। সবসময় মৃত্যু ও পরকালের কথা চিন্তা করতে হবে। নিজেকে এমনভাবে প্রস্ত্তত করতে হবে যেন অসুস্থতার পূর্বে সুস্থতাকে, ব্যস্ততার পূর্বে অবসরকে, দারিদ্রের পূর্বে প্রাচুর্যকে, বার্ধক্যের পূর্বে যৌবনকে, মৃত্যুর পূর্বে জীবনকে পুরোপুরিভাবে পরকালীন প্রস্ত্ততিতে কাজে লাগানো যায়।
  5. 5. নিজ সম্পর্কে সুধারণা না করা ও নিজের সৎকর্ম নিয়ে গর্ব অনুভব না করে তা আল্লাহর প্রতি সমর্পিত করা : নিজের প্রতি সুধারণার একটা খারাপ প্রতিক্রিয়া হল  তা পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হওয়া থেকে মানুষকে বাধা প্রদান করে। ইবনুল কাইয়্যিম বলেন, ‘আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে সন্তুষ্ট বোধ করা নেহায়েত বোকামী ও আল্লাহর হক্ব সম্পর্কে স্বল্পজ্ঞানের পরিচায়ক। অপরদিকে নিজের প্রতি সুধারণা জন্ম দেয় অহংকার, আত্মগর্ব ইত্যাদি অভ্যন্তরীণ বদ্উপসর্গ যা অনেক ক্ষেত্রে প্রকাশ্য কবীরা গুণাহের চেয়ে নিকৃষ্ট। এজন্য পাপীকে সংশোধন করার পূর্বে নিজেকে সংশোধনে মনোযোগী হওয়া যরূরী। একজন পাপীকে লজ্জিত করার চেয়ে নিজেকে তুচ্ছজ্ঞান করা অধিক উত্তম। আল্লাহর আনুগত্য, আল্লাহর প্রতি শোকরগোযার হওয়া, আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার জন্য এটাই অধিক কার্যকর (মাদারিজুস সালিকীন ১/১৭৫)
  6. 6.   আমলকে রিয়া (লোকপ্রদর্শনী) থেকে বিরত রাখা: লোক দেখানোর জন্য অথবা অন্যের নিকট প্রশংসা পাওয়া, দোষারোপ থেকে রেহাই পাওয়া, সম্মান-প্রতিপত্তি অর্জন, ক্ষমতা লাভ করা ইত্যাদি অসৎ উদ্দেশ্যে কৃত আমল আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। এ সমস্ত কাজ মানুষকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিখাদচিত্ত হওয়া (ইখলাছ) থেকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে তার নেকআমল আর অন্তর থেকে পালিত হয় না। তার অন্তর হয়ে পড়ে মৃত। তা আর আলোকিত হ’তে পারে না, পারে না সত্য-মিথ্যার মাঝে পার্থক্য চিহ্নিত করতে। হারিয়ে ফেলে আল্লাহর বন্ধু ও আল্লাহর শক্রদের মাঝে ব্যবধান করার যোগ্যতাটুকুও (ঐ ১/১৭৫)
  7. 7.   আত্মসমালোচনা : আল্লাহ রাববুল আলামীন পবিত্র কুরআনে মানব সম্প্রদায়কে নির্দেশ দিয়েছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর। প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য উচিৎ, আগামী কালের জন্য সে কি প্রেরণ করেছে তা চিন্তা করা’ (হাশর ১৮)। ওমর (রাঃ) এক খুৎবায় বলেন, হে মানুষ! তোমরা নিজেদের হিসাব নিজেরাই গ্রহণ কর, চূড়ান্ত দিবসে হিসাব গৃহীত হওয়ার পূর্বেই। তোমাদের অন্তরাত্মাকে তোমরা পরিমাপ কর চূড়ান্ত দিনের পরিমাপের পূর্বেই। কেননা আজকের দিনে নিজেকে পরিমাপ করা আগামী দিনের তুলনায় বহুগুণে সহজ। সেদিনের মঞ্চে উপস্থিত হওয়ার জন্য নিজেকে অলংকৃত করে সৌন্দর্য্যমন্ডিত করে নাও, যেদিন কোন গোপনকারীর গোপনীয়তা আর অপ্রকাশ্য থাকবে না। মায়মূন বিন মিহরান বলেন, কোন ব্যক্তি মুত্তাকী হ’তে পারে না যতক্ষণ না সে নিজের হিসাব গ্রহণ করে, যেমন সে অন্যের কাছে হিসাব নেয় যে, সে কোথা থেকে খাদ্য ও পোষাক সংগ্রহ করেছে। ইবনুল কাইয়্যিম বলেন, এমন অনেকে রয়েছে যে নেক আমল প্রচুর করে কিন্তু নিজের খারাপ গুণসমূহ দূর করার অবসর পায় না। ফলে অচিরেই তার মাঝে রিয়া, আত্মগর্ব ইত্যাদি বদগুণ পাহাড়ের মত স্থায়ী জায়গা করে নেয়, যাকে সে কিছুই মনে করে না। এজন্য আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি সে-ই যে সৎ আমল অধিক করে এবং সতর্কতার সাথে অসৎ গুণ থেকে দূরে থাকে। আল্লাহ বলেন, ‘তারা (মু‘মিনরা) রাতের কম অংশেই নিদ্রা যেত এবং শেষ রাতে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করত’ (যারিয়াত ১৮)
  8. 8.   কম ঘুমানো, কম খাওয়া ও কম কথা বলা :আল্লাহর স্মরণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অতিমাত্রায় কথা বলা অন্তরকে আবশ্যকীয়ভাবে কঠিন করে তোলে। আর কঠিন অন্তরের মানুষের অবস্থান আল্লাহ থেকে সবচেয়ে দূরে। অধিক মাত্রায় খানা-পিনা শয়তানী প্রবৃত্তিকে উস্কে দেয় এবং ঘুম বৃদ্ধি করে দেয়। আর অধিক ঘুম জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট করার সাথে সাথে আলস্য ও কর্মক্ষমতা হরাসেরও কারণ। এজন্য রাসূল (ছাঃ) সকল কাজে মধ্যপন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন।
  9. 9. ধৈর্য ও দৃঢ় বিশ্বাসের গুণ দ্বারা সুশোভিত হওয়া:প্রবৃত্তির উপর বিজয় লাভ করা, হারাম কাজ থেকে বিরত থাকা ও আল্লাহর আনুগত্যে অটল থাকার জন্য ধৈর্য অবলম্বন অপরিহার্য। আত্মশুদ্ধির দু’টি দিক ‘অর্জন’ ও ‘বর্জন’ ধৈর্য ব্যতীত আত্মস্থ করা অসম্ভব। আল্লাহ তা‘আলা ধৈর্য ধারণের অপরিসীম পুরস্কার নির্ধারণ করে রেখেছেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ধৈর্য হল আলো স্বরূপ (মুসলিম, মিশকাত হা/২৮১)। আর আত্মপ্রত্যয়, দৃঢ় বিশ্বাস মানুষকে পথভ্রষ্টতা থেকে পরিত্রাণ দেয় এবং প্রশান্তি ও স্থিরতা দান করে। এজন্য সুফিয়ান ছাওরী বলেন, ধৈর্য ও দৃঢ় বিশ্বাস মানুষকে দ্বীনের ব্যাপারে শ্রেষ্ঠত্ব দান করে। আল্লাহ বলেন, ‘তারা ছবর করত এবং আমার আয়াতের উপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখত বলে আমি তাদের মধ্য থেকেই নেতা নির্বাচন করেছিলাম’ (সিজদা ২৪)
  10. 10. দো‘আ করা : সর্বোপরি আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য আল্লাহর নিকট আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করা অপরিহার্য। কেননা আল্লাহর অনুগ্রহই কেবলমাত্র মানুষের সৎপথ প্রাপ্তি ও আত্মশুদ্ধি নিশ্চিত করতে পারে (নূর ২১)। দো‘আ মু‘মিনের অস্ত্রস্বরূপ। দো‘আর মাধ্যমেই সে আল্লাহর কাছে অকল্যাণ থেকে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং আল্লা্হর আনুগত্যের জন্য সাহায্যপ্রাপ্ত হয়। রাসূল (ছাঃ) এজন্য দো‘আ করতেন,اللَّهُمَّ اهْدِنِى لأَحْسَنِ الأَخْلاَقِ وَأَحْسَنِ الأَعْمَالِ لاَ يَهْدِى لأَحْسَنِهَا إِلاَّ أَنْتَ وَقِنِى سَيِّئَ الأَخْلاَقِ وَالأَعْمَالِ لاَ يَقِى سَيِّئَهَا إِلاَّ أَنْتَ – ‘হে প্রভু! তুমি আমাকে সর্বোত্তম চরিত্র ও সর্বোত্তম আমলের দিকে পথ-প্রদর্শন কর। কেননা উৎকৃষ্টতার দিকে পথপ্রদর্শন করার সাধ্য তুমি ছাড়া আর কারো নেই। তুমি আমাকে অসৎ চরিত্র ও অসৎ আমল হ’তে পরিত্রাণ দাও। কেননা তুমি ব্যতীত কেউই বদস্বভাব থেকে উদ্ধার করতে পারে না’ (নাসাঈ, মিশকাত হা/৮২০)। اللَّهُمَّ أنْعِشْنِي واجْبُرْنِي واهْدِني لِصالِحِ الأَعْمالِ والأَخْلاقِ فإنَّهُ لا يَهْدِي لِصالِحِها ولا يَصْرِفُ سَيِّئَها إلاَّ أنْتَ   ‘হে প্রভু! আমাকে পরিশুদ্ধ করে দাও, আমাকে সংশোধন করে দাও এবং সৎকর্ম ও সৎচরিত্রের দিকে আমাকে পথ দেখিয়ে দাও। কেননা সুপথপ্রদর্শন করা ও কুপথ থেকে ফিরিয়ে আনার সাধ্য তুমি ব্যতীত কারো নেই’ (আল জামে‘ঊছ ছাগীর হা/২১৪৬)

আল্লাহ আমাদের সকলকে পরিশুদ্ধ অন্তরের অধিকারী হওয়ার তাওফীক্ব দান করুন। – আমীন!

  লেখক-মুহাম্মাদ আরীফুল ইসলাম

খারেজীদের আক্বীদা ও ইতিহাস 

bonfire_05_hd_picture_166682.png

খারেজীদের আক্বীদা ও ইতিহাস 

আভিধানিক অর্থে ‘খারেজী’ শব্দটি আরবী ‘খুরূজ’ (الخروج) শব্দ হ’তে নির্গত, যার অর্থ ‘বের হওয়া বা বেরিয়ে যাওয়া’। বহুবচনে ‘খাওয়ারিজ’ ব্যবহৃত হয়। পারিভাষিক অর্থে শাহরাস্তানী (মৃঃ ৫৪৮ হিঃ) এর মতে খারেজী হ’ল- ‘প্রত্যেক এমন ব্যক্তি যে এমন হক ইমামের (শাসক) বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, যাকে লোকেরা ইমাম হিসাবে স্বীকার করে নিয়েছে। চাই এই বিদ্রোহ ছাহাবীগণের যুগে হেদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদার বিরুদ্ধে হোক বা তাদের পরবর্তী তাবেঈনে এযামের যুগে কিংবা তৎপরবর্তী যে কোন শাসকের যুগে হোক’।

ইবনু হাযম আন্দালুসী (রহঃ)-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘খারেজী বলতে প্রত্যেক এমন সম্প্রদায়কে বুঝায় যারা চতুর্থ খলীফা আলী (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারীদের মতামত কিংবা তাদের রায় অবলম্বনকারী, তা যেকোন যুগেই হোক না কেন’। ড. নাছির আল-আক্বল বলেন, ‘খারেজী হচ্ছে, যারা গোনাহের কারণে অন্য মুসলমানকে কাফের বলে এবং মুসলিম শাসক ও সাধারণ লোকজনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে’। তিনি আরো বলেন, ‘খারেজী’ নামটি যেমন পূর্বের খারেজীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তেমনি প্রত্যেক এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, যে তাদের নীতি গ্রহণ করে এবং তাদের পন্থা অবলম্বন করে। উপরোক্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী তাদের প্রধান দু’টি আলামত বা লক্ষণ হ’ল, তারা কবীরা গোনাহগারকে কাফের বলে এবং মুসলিম শাসকের বিরদ্ধে বিদ্রোহ করে। তাদেরকে ‘খারেজী’ বলা হয় এজন্য যে, তারা দ্বীন অথবা জামা‘আত অথবা আলী (রাঃ)-এর আনুগত্য থেকে বের হয়ে গিয়েছিল।

রাসূল (ছাঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী ও খারেজীদের উত্থান :

ইসলামের প্রথম বাতিল দল হ’ল ‘খারেজী’। অনেকে মনে করেন খারেজীদের উত্থান রাসূল (ছাঃ)-এর যুগেই হয়েছিল। কিন্তু তা ছিল ব্যক্তি পর্যায়ের ঘটনা। এর প্রমাণ স্বরূপ তারা ‘যুল খুওয়াইছারা’র ঘটনা উল্লেখ করেন। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন,

بَيْنَمَا نَحْنُ عِنْدَ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَهْوَ يَقْسِمُ قَسْمًا أَتَاهُ ذُو الْخُوَيْصِرَةِ، وَهْوَ ‏رَجُلٌ ‏مِنْ بَنِي تَمِيْمٍ، فَقَالَ يَا ‏رَسُولَ اللَّهِ اعْدِلْ. فَقَالَ وَيْلَكَ، وَمَنْ يَعْدِلُ إِذَا لَمْ ‏أَعْدِلْ قَدْ ‏خِبْتَ وَخَسِرْتَ إِنْ لَمْ أَكُنْ أَعْدِلُ فَقَالَ ‏عُمَرُ يَا رَسُولَ اللهِ ائْذَنْ لِي ‏فِيهِ، ‏فَأَضْرِبَ عُنُقَهُ. فَقَالَ دَعْهُ فَإِنَّ لَهُ أَصْحَابًا، يَحْقِرُ أَحَدُكُمْ صَلاَتَهُ ‏مَعَ ‏صَلاَتِهِمْ ‏وَصِيَامَهُ مَعَ صِيَامِهِمْ، يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ لاَ يُجَاوِزُ تَرَاقِيَهُمْ، يَمْرُقُونَ ‏مِنَ الدِّينِ كَمَا ‏يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنَ ‏الرَّمِيَّةِ، يُنْظَرُ إِلَى نَصْلِهِ فَلاَ يُوجَدُ فِيهِ شَىْءٌ، ‏ثُمَّ يُنْظَرُ إِلَى ‏رِصَافِهِ فَمَا يُوجَدُ فِيهِ شَىْءٌ، ثُمَّ يُنْظَرُ إِلَى نَضِيِّهِ، ‏وَهُوَ قِدْحُهُ، ‏فَلاَ يُوجَدُ فِيهِ ‏شَىْءٌ، ثُمَّ يُنْظَرُ إِلَى قُذَذِهِ فَلاَ يُوجَدُ فِيهِ شَىْءٌ، قَدْ سَبَقَ الْفَرْثَ ‏وَالدَّمَ، آيَتُهُمْ ‏رَجُلٌ ‏أَسْوَدُ إِحْدَى عَضُدَيْهِ مِثْلُ ثَدْىِ الْمَرْأَةِ، أَوْ مِثْلُ الْبَضْعَةِ ‏تَدَرْدَرُ وَيَخْرُجُونَ عَلَى ‏حِينِ فُرْقَةٍ مِنَ النَّاسِ-

‘আমরা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে উপস্থিত ছিলাম। তিনি কিছু গণীমতের মাল বণ্টন করছিলেন। তখন বনু তামীম গোত্রের ‘যুল খুওয়াইছারা’ নামক এক ব্যক্তি এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি ইনছাফ করুন’। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, তোমার দুর্ভাগ্য! আমি যদি ইনছাফ না করি, তাহ’লে কে ইনছাফ করবে? আমি যদি ইনছাফ না করি, তাহ’লে তো তুমি ক্ষতিগ্রস্ত ও নিষ্ফল হব। ওমর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ! আপনি আমাকে অনুমতি দিন, আমি ওর গর্দান উড়িয়ে দেই। তিনি বললেন, ‘ওকে যেতে দাও। তার কিছু সঙ্গী-সাথী রয়েছে। তোমাদের কেউ তাদের ছালাতের তুলনায় নিজের ছালাত এবং তাদের ছিয়ামের তুলনায় নিজের ছিয়ামকে তুচ্ছ মনে করবে। এরা কুরআন পাঠ করে, কিন্তু কুরআন তাদের কণ্ঠনালীর নিম্নদেশে প্রবেশ করে না। এরা দ্বীন থেকে এত দ্রুত বেরিয়ে যাবে, যেমন তীর শিকার ভেদ করে বেরিয়ে যায়। তীরের অগ্রভাগের লোহা দেখা যাবে, কিন্তু (শিকারের) চিহ্ন দেখা যাবে না। কাঠের অংশটুকু দেখলে তাতেও কোন কিছুর দেখা মিলবে না। মধ্যবর্তী অংশটুকু দেখলে তাতেও কিছু পাওয়া যাবে না। তার পালক দেখলে তাতেও কোন চিহ্ন পাওয়া যাবে না। অথচ তীরটি শিকারের নাড়িভুঁড়ি ভেদ করে রক্ত-মাংস অতিক্রম করে বেরিয়ে গেছে। এদের নিদর্শন হ’ল এমন একজন কালো মানুষ, যার একটি বাহু নারীর স্তনের ন্যায় অথবা গোশতের টুকরার ন্যায় নড়াচড়া করবে। তারা মানুষের মধ্যে বিরোধ কালে আত্মপ্রকাশ করবে।[1]

অন্য বর্ণনায় এসেছে,

فَلَمَّا وَلَّى قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم إِنَّ مِنْ ضِئْضِئِ هَذَا قَوْمًا يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ لاَ ‏يُجَاوِزُ ‏حَنَاجِرَهُمْ، يَمْرُقُونَ مِنَ ‏الإِسْلاَمِ مُرُوقَ السَّهْمِ مِنَ الرَّمِيَّةِ، يَقْتُلُونَ أَهْلَ ‏الإِسْلاَمِ ‏وَيَدَعُونَ أَهْلَ الأَوْثَانِ، لَئِنْ أَدْرَكْتُهُمْ لأَقْتُلَنَّهُمْ قَتْلَ ‏عَادٍ-

‘লোকটি চলে যাওয়ার পর রাসূল (ছাঃ) বললেন, ঐ ব্যক্তির বংশ থেকে এমন কিছু লোক আসবে যারা কুরআন পড়বে, কিন্তু কুরআন তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তারা ইসলাম থেকে এমনভাবে বের হয়ে যাবে যেমন শিকারের দেহ ভেদ করে তীর বের হয়ে যায়। তারা মূর্তিপূজারীদেরকে ছেড়ে দিবে এবং মুসলমানদেরক হত্যা করবে। যদি আমি তাদেরকে পাই তাহ’লে ‘আদ’ জাতির মত তাদেরকে হত্যা করব’।[2]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে ‘জি‘রানা’ নামক স্থানে দেখা করে। এটি সেই স্থান যেখানে রাসূল (ছাঃ) হুনায়নের যুদ্ধে প্রাপ্ত গণীমতের মাল বণ্টন করছিলেন। ছাহাবী বিলাল (রাঃ)-এর কাপড়ের ওপর রূপার টুকরাগুলো রাখা ছিল। রাসূল (ছাঃ) মুষ্ঠিবদ্ধভাবে মানুষকে দান করছিলেন। তখন উপস্থিত ঐ লোকটি বলল, ‘হে মুহাম্মাদ! আপনি আল্লাহ্কে ভয় করুন ও ইনছাফ করুন! রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘ধ্বংস তোমার জন্য। আমি যদি ইনছাফ না করি তবে কে ইনছাফ করবে? আল্লাহর কসম! আমার পরে তোমরা এমন কোন লোক পাবে না, যে আমার চেয়ে অধিক ন্যায়পরায়ণ হবে’। সঙ্গে সঙ্গে ওমর (রাঃ) বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমাকে অনুমতি দিন, আমি এই মুনাফিকের গর্দান উড়িয়ে দেই’। তিনি বললেন, ‘না, আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই, যদি এমন কর, তবে লোকেরা বলবে, আমি আমার সাথীদের হত্যা করি…’।[3] এই ব্যক্তিই ছিল প্রথম ‘খারেজী’ যে নবী করীম (ছাঃ)-এর বণ্টনের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে এবং নিজ প্রবৃত্তির রায়কে প্রাধান্য দেয়।

অন্যদিকে ওছমান (রাঃ)-এর হত্যার ষড়যন্ত্রকারী এবং পরে অন্যায়ভাবে তাঁকে হত্যাকারী উচ্ছৃঙ্খল জনতাকেও ত্বাবারী ও ইবনু কাছীর (রহঃ) ‘খারেজী’ বলে অভিহিত করেছেন। তবে তখনও ‘খারেজী’ একটি পৃথক দল ও মতবাদ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেনি। এই ব্যক্তির বংশধর ও অনুসারীরাই ‘খারেজী’। এরা কেমন হবে? কি করবে? রাসূল (ছাঃ) এ সম্পর্কে বিস্তারিত ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। তিনি বলেন,

سَيَخْرُجُ قَوْمٌ فِى آخِرِ الزَّمَانِ، حُدَّاثُ الأَسْنَانِ، سُفَهَاءُ الأَحْلاَمِ، يَقُولُونَ مِنْ خَيْرِ قَوْلِ الْبَرِيَّةِ، لاَ يُجَاوِزُ إِيمَانُهُمْ حَنَاجِرَهُمْ-

‘শেষ যামানায় এমন এক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটবে যারা হবে অল্পবয়স্ক যুবক ও নির্বোধ। তারা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম কথা থেকে আবৃত্তি করবে। অথচ তাদের ঈমান তাদের গলদেশ অতিক্রম করবে না…’।[4]

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) অন্যত্র বলেন,

يَخْرُجُ نَاسٌ مِنْ قِبَلِ الْمَشْرِقِ وَيَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ لاَ يُجَاوِزُ تَرَاقِيَهُمْ، يَمْرُقُونَ مِنَ الدِّينِ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنَ الرَّمِيَّةِ، ثُمَّ لاَ يَعُودُونَ فِيهِ حَتَّى يَعُودَ السَّهْمُ إِلَى فُوقِهِ. قِيلَ مَا سِيمَاهُمْ. قَالَ سِيمَاهُمُ التَّحْلِيقُ. أَوْ قَالَ التَّسْبِيد-‏

‘পূর্বাঞ্চল থেকে একদল লোকের আবির্ভাব ঘটবে। তারা কুরআন পাঠ করবে, কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তারা দ্বীন থেকে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে, যেভাবে ধনুক শিকার ভেদ করে বেরিয়ে যায়। তারা আর দ্বীনের মধ্যে ফিরে আসবে না, যেমনভাবে ধনুক ছিলায় ফিরে আসে না। বলা হ’ল, তাদের আলামত কি? তিনি বললেন, ‘তাদের আলামত হচ্ছে মাথা মুন্ডন করা’।[5]

মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক করে রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন, ‘অদূর ভবিষ্যতে আমার উম্মতের মধ্যে মতানৈক্য ও ফিরক্বা সৃষ্টি হবে। এমতাবস্থায় এমন এক সম্প্রদায় বের হবে, যারা সুন্দর ও ভাল কথা বলবে আর কাজ করবে মন্দ। তারা কুরআন পাঠ করবে, কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তারা দ্বীন থেকে এমনভাবে বের হয়ে যাবে, যেমনভাবে তীর শিকার ভেদ করে বেরিয়ে যায়। তারা সৃষ্টির সবচেয়ে নিকৃষ্ট। ঐ ব্যক্তির জন্য সুসংবাদ, যে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে এবং যুদ্ধে তাদের দ্বারা শাহাদত বরণ করবে। তারা মানুষকে আল্লাহর কিতাবের দিকে ডাকবে অথচ তারা আমার কোন আদর্শের উপরে প্রতিষ্ঠিত নয়। যে ব্যক্তি তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে, সে অপরাপর উম্মতের তুলনায় আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় হবে’। ছাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তাদের আলামত কী? তিনি বললেন, ‘অধিক মাথা মুন্ডন করা’।[6]

খারেজী মতবাদ সৃষ্টির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট :

রাসূল (ছাঃ)-এর ইন্তিকালের পর তাঁর সকল ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত খারেজীরা আত্মপ্রকাশ করে। হিজরী ৩৭ সালে একটি ঘটনার মাধ্যমে তাদের সম্পর্কে সকল ধারণা স্পষ্ট হয়ে যায়। আলী (রাঃ)-এর শাসনামলে খলীফা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মুনাফিক ও খারেজীদের চক্রান্তে মুসলমানরা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এক দল আলী (রাঃ)-এর এবং অন্য দল মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর পক্ষাবলম্বন করে। ক্রমে অবস্থা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দিকে এগিয়ে যায়। অবশেষে ৬৫৭ সালের জুলাই মাসে ‘ছিফ্ফীন’ নামক স্থানে আলী (রাঃ)-এর সাথে মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধকালে সমস্যার সমাধানের লক্ষে দু’জন বিচারক নির্ধারণ করা হয় এই মর্মে যে, তারা দু’জনে মুসলিম উম্মাহর কল্যাণের জন্য যে সিদ্ধান্ত দিবেন তা উভয় পক্ষ মেনে নিবে। আলী (রাঃ)-এর পক্ষ থেকে আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) এবং মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর পক্ষ থেকে আমর ইবনুল আছ (রাঃ)-কে নির্ধারণ করা হয়। ঘটনাটি ইসলামের ইতিহাসে ‘তাহকীম’ বা সালিস নির্ধারণ নামে পরিচিত। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর শাম ও ইরাকের সকল ছাহাবীর ঐক্যমতে বিচার ব্যবস্থা পৃথকীকরণ এবং আলী (রাঃ)-এর কুফায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সিদ্ধান্তকে অমান্য করে তখনই আলী (রাঃ)-এর দল থেকে কিছু লোক বের হয়ে যায় এবং ‘হারুরা’ নামক প্রান্তরে এসে অবস্থান করে। তাদের সংখ্যা মতান্তরে ৬, ৮, ১২ অথবা ১৬ হাযার হবে। বিচ্ছিন্নতার সংবাদ পেয়ে আলী (রাঃ) দূরদর্শী ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ)-কে তাদের নিকট প্রেরণ করেন। তিনি তাদের সংশয়গুলিকে বিচক্ষণতার সাথে খন্ডন করায় বেরিয়ে যাওয়াদের মধ্য থেকে প্রায় ৪ অথবা ৬ হাযার লোক আলী (রাঃ)-এর আনুগত্যে ফিরে আসেন। অতঃপর আলী (রাঃ) কুফার মসজিদে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলে মসজিদের এক কোনায় ‘লা হুকমা ইল্লা লিল্লাহ’ ‘আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম মানি না’ স্লোগানে তারা মসজিদ প্রকম্পিত করে তুলে। তারা আলী (রাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলে যে, আপনি বিচার ব্যবস্থা মানুষের হাতে তুলে দিয়েছেন! অথচ বিচারের মালিক হচ্ছেন আল্লাহ্। আপনি সূরা আন‘আমের ৫৭নং আয়াত (ان الحكم الا لله) ‘আল্লাহ ব্যতীত কারো ফায়ছালা গ্রহণযোগ্য নয়’-এর হুকুম ভঙ্গ করেছেন। আল্লাহর বিধানের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের দরুন আপনি মুশরিক হয়ে গেছেন ইত্যাদি।

তাদের মতে আলী, মু‘আবিয়া, আমর ইবনুল আছ সহ তাহকীমকে সমর্থনকারী সকল ছাহাবী কুফরী করেছেন এবং কাফের হয়ে গেছেন। অথচ সত্য হ’ল, মানুষের ফায়ছালার জন্য মানুষকেই বিচারক হ’তে হবে। আর ফায়ছালা হবে আল্লাহর আইন অনুসারে।

খারেজীরা নিজেদের এই নির্বুদ্ধিতাকে ধর্মীয় গোঁড়ামিতে রূপ দান করে এবং মুসলমানদের মাঝে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা করে। আলী (রাঃ) তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘তোমাদের ব্যাপারে আমরা তিনটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ১. তোমাদেরকে মসজিদে আসতে আমরা নিষেধ করব না ২. রাষ্ট্রীয় সম্পদ হ’তে আমরা তোমাদের বঞ্চিত করব না ৩. তোমরা আগে ভাগে কিছু না করলে আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না।

কিছুদিন পর তারা সাধারণ মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতে শুরু করে। তখন আব্দুল্লাহ বিন খাববাব (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর ফিৎনা সংক্রান্ত হাদীছ শুনালে তারা তাঁকে হত্যা করে। তাঁর গর্ভবতী স্ত্রীর পেট ফেড়ে বাচ্চা বের করে ফেলে দেয় এবং দু’টুকরো করে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। আলী (রাঃ) জিজ্ঞেস করেন, ‘আব্দুল্লাহ্কে কে হত্যা করেছে? জবাবে তারা ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে বলে, আমরা সবাই মিলে হত্যা করেছি। এরপর আলী (রাঃ) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্ত্ততি নেন। যুদ্ধের আগে তিনি নিজে ইবনু আববাস ও আবু আইয়ূব (রাঃ) সহ তাদের সাথে কয়েক দফা আলোচনা করেন এবং তাদের সংশয়গুলিকে দূর করতঃ সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন।

আলী (রাঃ)-এর পক্ষ থেকে খারেজীদের সংশয় সমূহের যথার্থ জবাব :

খারেজীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পূর্বে আলী (রাঃ) তাদের বেরিয়ে যওয়ার কারণগুলি জানতে চাইলে তারা কিছু সংশয় উপস্থাপন করে এবং তিনি প্রত্যেকটির যথার্থ জবাব দেন। তাদের সংশয়গুলির সংক্ষিপ্ত জবাব নিমণরূপ-

প্রথম সংশয় : উষ্ট্রের যুদ্ধে তাদের জন্য নারী ও শিশুদেরকে যুদ্ধবন্দী ও ক্রীতদাস হিসাবে গ্রহণ করার বৈধতা কেন দেওয়া হয়নি, যেমন দেওয়া হয়েছিল অর্থ-সম্পদের ক্ষেত্রে? আলী (রাঃ) জবাব দেন কয়েকটি দিক থেকে, (১) ত্বালহা ও যুবায়র (রাঃ) বায়তুল মাল থেকে যে সামান্য অর্থ নিয়েছিলেন তার বিনিময়ে তাদের জন্য মাল নেয়ার বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। তাছাড়াও তা ছিল খুবই সামান্য সম্পদ। (২) নারী ও শিশুরা তো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। তাছাড়াও তারা ইসলামী ভূমিতে বসবাসকারী মুসলিম। তারা মুরতাদ হয়েও যায়নি যে, তাদেরকে ক্রীতদাস হিসাবে গ্রহণ করা জায়েয হবে। (৩) তিনি তাদেরকে বলেন, ‘আমি যদি নারী ও শিশুদেরকে ক্রীতদাস হিসাবে গ্রহণ করা বৈধ করতাম তাহ’লে তোমাদের মধ্যে কে আছে যে (উম্মুল মুমিনীন) আয়েশা (রাঃ)-কে নিজের অংশে ক্রীতদাস হিসাবে গ্রহণ করার যোগ্যতা রাখ?! তখন নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে তাদের মধ্যে অনেকেই সঠিক পথে ফিরে এসে আলী (রাঃ)-এর আনুগত্য মেনে নেয়।

দ্বিতীয় সংশয় : আলী (রাঃ) কেন মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর সাথে ছিফ্ফীনের সন্ধি চুক্তি লেখার সময় নিজের নামের প্রথমে ‘আমীরুল মুমিনীন’ কথাটি মুছে ফেলেন এবং তাঁর কথা মেনে নিলেন? তিনি জবাব দেন এই বলে যে, ‘আমি তো তাই করেছি যা স্বয়ং রাসূল (ছাঃ) হুদায়বিয়ার সন্ধিতে করেছিলেন। তিনি নিজের নামের প্রথম থেকে ‘রাসূলুল্লাহ’ শব্দটি কাফেরদের দাবী অনুযায়ী মুছে ফেলেন’।

তৃতীয় সংশয় : তিনি হকের পথে থাকার পরেও কেন তাহকীম বা শালিস নিয়োগ করলেন? এর জবাবে তিনি বলেন, ‘হক্বের পথে থাকার পরেও রাসূল (ছাঃ) বানু কুরায়যা-এর ক্ষেত্রে সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ)-কে শালিস নিয়োগ করেছিলেন’।

চতুর্থ সংশয় : আলী (রাঃ) বলেছিলেন, ‘আমি যদি খেলাফতের হকদার হয়ে থাকি, তাহ’লে তারা আমাকে খলীফা নির্বাচন করবে’। খারেজীদের দাবী তিনি নিজের খলীফা হওয়ার যোগ্যতার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেছেন। এর জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা ছিল মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর প্রতি ইনছাফ করা। যেমন রাসূল (ছাঃ) নাজরানের নাছারাদেরকে মুবাহালার জন্য আহবান করেছিলেন তাদের প্রতি ইনছাফ প্রদর্শনের জন্য। এরপর তাদের অনেকেই নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে ফিরে আসে এবং তাঁর আনুগত্য মেনে নেয়। আর বাকীদের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ করেন, যা ‘নাহরাওয়ান’ যুদ্ধ নামে পরিচিত। এতে তারা নয় জন ব্যতীত সকলেই নিহত হয়। পক্ষান্তরে আলী (রাঃ)-এর পক্ষের নয় জন শাহাদত বরণ করেন। এই যুদ্ধেই খারেজী নেতা আব্দুল্লাহ বিন ওহাব রাসবী নিহত হয়। যুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে খারেজীরা পরাজিত হয় এবং তাদের ফিৎনাও সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। বলা হয়, সেদিন বেঁচে যাওয়া নয়জন খারেজীই বিভিন্ন দেশে তাদের বীজ বপন করে। পরাজিত খারেজীদের বংশধর ও অনুসারীরা এর পরেও বিভিন্ন সময় আত্মপ্রকাশ করে এবং ফিৎনা-ফাসাদ বাধানোর চেষ্টা করে। যদিও রাসূল (ছাঃ)-এর সময়ে ও পরবর্তীতে আবুবকর, ওমর ও ওছমান (রাঃ)-এর যুগে কিছু খারেজী আক্বীদার লোক ছিল, কিন্তু তাদের ফিৎনা সবচাইতে মারাত্মক আকার ধারণ করে আলী (রাঃ)-এর খিলাফতকালে। সেই থেকে যুগে যুগে বিভিন্ন নামে-বেনামে খারেজী দল বা ব্যক্তির আবির্ভাব হয়েছে।

খারেজীদের কিছু বৈশিষ্ট্য ও আলামত :

১. তারা হবে নবীন, তরুণ ও নির্বোধ, অথচ নিজেদেরকে অনেক জ্ঞানী ভাববে।[7]

২. তারা সর্বোত্তম কথা বলবে, কিন্ত সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ করবে।[8]

৩. বাহ্যিকভাবে সুন্দর কথা বলবে।[9]

৪. মুখে ঈমানের কথা বললেও তাদের অন্তরে ঈমানের লেশমাত্র থাকবে না।[10]

৫. তাদের ঈমান ও ছালাত তাদের গ্রীবাদেশ অতিক্রম করবে না।[11] ৬. পথভ্রষ্ট হওয়ার পর এরা আর ঈমানের দিকে ফিরে আসবে না। যেমন তীর আর ধনুকের ছিলাতে ফিরে আসে না।[12]

৭. তারা হবে ইবাদতে অন্যদের চেয়ে অগ্রগামী কিন্তু নিজেদের ইবাদতের জন্য হবে অহংকারী। লোকেরা তাদের ইবাদত দেখে অবাক হবে।[13]

৮. তাদের নিদর্শন হ’ল, তাদের মাথা থাকবে ন্যাড়া।[14]

৯. তারা মুসলমানদের হত্যা করবে আর কাফের, মুশরিক ও মূর্তিপূজারীদের ছেড়ে দিবে।[15]

১০. তারা দ্বীনদারিতার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করবে, এমনকি দ্বীন থেকে বেরিয়ে যাবে।[16]

১১. তারা মুসলিম শাসকদের নিন্দা করে, অপবাদ দেয় এবং তাদেরকে পথভ্রষ্ট ও কাফির বলে দাবী করে। যেমনটি খুওয়াইছারা রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে করেছিল।

১২. তারা মানুষকে কিতাবুল্লাহর দিকে আহবান করবে। কিন্তু সে বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞানই থাকবে না। অর্থাৎ কিতাবুল্লাহ দিয়ে দলীল গ্রহণ করবে। কিন্তু না বুঝার কারণে দলীল গ্রহণের ক্ষেত্রে ভুল করবে।[17]

১৩. তারা ইবাদতের ক্ষেত্রে কঠোরতা আরোপ করবে।[18]

১৪. তারা সর্বোত্তম দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে। যেমন আলী ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে করেছিল।[19]

১৫. তারা তাদের নিহতদেরকে জান্নাতী মনে করে। যেমন তারা নাহ্রাওয়ানের যুদ্ধের ময়দানে পরস্পরকে ‘জান্নাতমুখী’ ‘জান্নাতমুখী’ বলে ডাকছিল’।[20]

১৬. ওরা এমন জাতি যাদের অন্তরে রয়েছে বক্রতা।[21]

১৭. মতভেদ ও মতানৈক্যের সময় এদের আবির্ভাব হবে।[22] ১৮. তাদের উৎপত্তি পূর্ব দিক (ইরাক ও তৎসংলগ্ন) থেকে হবে।[23]

১৯. যেসব আয়াত কাফেরের জন্য প্রযোজ্য তারা সেগুলিকে মুমিনদের উপর প্রয়োগ করবে।[24]

২০. তাদের আগমন ঘটবে শেষ যামানায়।[25]

২১. তারাও কুরআন ও সুন্নাহ দিয়েই কথা বলবে কিন্তু অপব্যাখ্যা করবে।[26] ফলে তারা আলেমদের সাথে সবচেয়ে বেশী শত্রুতা পোষণকারী হবে। প্রতিপক্ষের বিরোধিতা করতে গিয়ে জাল হাদীছ পর্যন্ত রচনা করে।[27]

২২. সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের নামে এ সম্পর্কিত শরী‘আতের দলীলগুলিকে শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে থাকে।

২৩. তারা কেবল ভীতি প্রদর্শন সংক্রান্ত আয়াতগুলি দিয়ে দলীল গ্রহণ করে। কিন্তু ভাল কাজের পুরস্কার বা উৎসাহমূলক আয়াতগুলিকে পরিত্যাগ করে।

২৪. তারা আলেমগণকে মূল্যায়ন করবে না। নিজেদেরকেই বড় জ্ঞানী মনে করবে। যেমন খারেজীরা নিজেদেরকে আলী, ইবনু আববাস সহ সকল ছাহাবী (রাঃ)-এর চেয়ে জ্ঞানী দাবী করেছিল।

২৫. ওরা হুকুম লাগানোর ক্ষেত্রে তড়িঘড়ি করে।[28]

২৬. তারাই সর্বপ্রথম মুসলিমদের জামা‘আত হ’তে বেরিয়ে গেছে এবং তাদেরকে পাপের কারণে কাফের সাব্যস্ত করেছে।[29]

২৭. তারা ক্বিয়াস (ধারণা বা অনুমান) ভিত্তিক কাজে বেশী বিশ্বাসী।[30]

২৮. তারা মনে করে যালেম শাসকের শাসন জায়েয নয়।[31] ৩০. ওরা মুখে আহলে ইল্মদের কথার বকওয়ায করে কিন্তু তার মর্মাথ বুঝে না।[32]

৩০. ওরা লোকদেরকে মুসলিম সমাজ হ’তে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আহবান জানায়। ফলে তারা নিজেরা মাদরাসা, শিক্ষা ইন্সটিটিউট, বিশববিদ্যালয়, সরকারী চাকুরী এবং মুসলমানদের সাথে বসবাস করা পরিহার করে।[33]

৩১. তারা আত্মহত্যার মাধ্যমে এবং অন্যকে হত্যার মাধ্যমে সীমালংঘন করতঃ রক্তপাত ঘটাবে।

৩২. যতবারই তাদের আবির্ভাব হবে, ততবারই তারা ধ্বংস হবে। এভাবে রাসূল (ছাঃ) বিশ বার বলেন।[34]

৩৪. ভূপৃষ্ঠে সর্বদাই খারেজী আক্বীদার লোক থাকবে এবং সর্বশেষ এদের মাঝেই দাজ্জালের আবির্ভাব হবে।[35]

৩৫. তারা হবে সর্বনিকৃষ্ট সৃষ্টি।[36]

খারেজীদের বিষাক্ত ছোবলে কলংকিত ইসলামের ইতিহাস :

খলীফা আবুবকর ও ওমর (রাঃ)-এর সময় খারেজীরা মাথাচাড়া দিতে পারেনি। কিন্তু আবু লু’লু নামক জনৈক অগ্নিপূজক বাহ্যিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করে গোপনে মদীনায় প্রবেশ করে। ২৩ হিজরীর ২৬শে যিলহজ্জ তারিখে ওমর (রাঃ) ফজরের ছালাতে ইমামতি করছিলেন, এমন সময় সে ছদ্মবেশে প্রথম কাতারে অবস্থান নেয়। অতঃপর সুযোগ বুঝে তীক্ষ্ণ তরবারী দ্বারা তিন অথবা ছয়বার তাঁর কোমরে আঘাত করে। তিনদিন পর তিনি শাহাদত বরণ করেন। ফলে চরমপন্থী তৎপরতার পুনরুত্থান ঘটে। উল্লেখ্য, ঐ দিন সে আরো ১৩ জন ছাহাবীকে আঘাত করে। তন্মধ্যে ৯ জন শাহাদত বরণ করেন। ঐ ঘাতক পালিয়ে যেতে না পেরে নিজের অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করে।

ইহুদী আব্দুল্লাহ বিন সাবার ষড়যন্ত্রে খারেজী চরমপন্থীদের হাতেই ৩৫ হিজরীর ১৮ই যিলহজ্জ তারিখ জুম‘আর দিন রাসূল (ছাঃ)-এর জামাতা ৮২ বছর বয়সী ওছমান (রাঃ) নির্মমভাবে শাহাদত বরণ করেন। নাহরাওয়ানের যুদ্ধে বেঁচে যাওয়া খারেজীরা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে। অতঃপর তারা আলী (রাঃ)-কে হত্যা করার জন্য গোপনে আব্দুর রহমান বিন মুলজামকে ঠিক করে। অনুরূপভাবে মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর কে হত্যা করার জন্য বারাক বিন আব্দুল্লাহকে এবং আমর ইবনুল আছ (রাঃ)-কে হত্যা করার জন্য আমর বিন বাকরকে নির্বাচন করে। এভাবে তারা একই দিনে হত্যা করার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে বেরিয়ে পড়ে। আব্দুর রহমান বিন মুলজাম তার দু’জন সহযোগী ওরদান ও শাবীবকে সঙ্গে নিয়ে ৪০ হিজরীর ১৭ই রামাযান জুম‘আর রাতে কূফায় গমন করে। ফজরের সময় আলী (রাঃ)-এর বাড়ীর দরজার আড়ালে অস্ত্র নিয়ে ওঁৎ পেতে থাকে। তিনি বাড়ী থেকে বের হয়ে যখন ‘ছালাত’ ‘ছালাত’ বলে মানুষকে ডাকতে ডাকতে মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন, তখনই তারা আলী (রাঃ)-এর মাথায় অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। এতে তাঁর দাড়ি রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এ সময় আলী (রাঃ)-কে লক্ষ্য করে ঐ রক্তপিপাসু বলেছিল,لا حكم إلا لله ليس لك يا علي ولا لأصحابك، ‘হে আলী! আল্লাহ ছাড়া কারো বিধান নেই। তোমার জন্যও নেই এবং তোমার সাথীদের জন্যও নেই হে আলী’। তাকে হত্যা করার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলে উঠে,شحذته أربعين صباحا وسألت الله أن أقتل به شر خلقه ‘আমি চল্লিশ দিন যাবৎ তরবারিকে ধার দিয়েছি এবং আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেছি, আমি যেন এই অস্ত্র দ্বারা তাঁর সৃষ্টির মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট ব্যক্তিকে হত্যা করতে পারি’ (নাঊযুবিল্লাহ্)।

আলী (রাঃ) বলেছিলেন, আমি মারা গেলে তোমরা তাকে হত্যা করবে। আর বেঁচে থাকলে আমিই যা করার করব। কিন্তু তিনদিন পর ৪০ হিজরীর ২১শে রামাযান ৬৩ বা ৬৪ বছর বয়সে তিনি শাহাদত বরণ করেন। ঐ দিন একই সময় মু‘আবিয়া (রাঃ)-কে আঘাত করলে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। আমর ইবনুল আছ (রাঃ) ভীষণ অসুস্থ থাকায় তিনি সেদিন মসজিদে আসতে পারেননি। ফলে তিনি বেঁচে যান। তবে তাঁর স্থলাভিষিক্ত ইমাম খারেজাহ ইবনু আবী হাবীবাকে ঐ ঘাতক হত্যা করে। এভাবেই খারেজীরা খুলাফায়ে রাশেদার মত জান্নাতী ও বিশিষ্ট ছাহাবীগণের প্রাণনাশ ঘটিয়ে ইসলামের সোনালী ইতিহাসকে কলংকিত করে।

খারেজীদের অপব্যাখ্যা ও তার জবাব :

খারেজীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য কুরআন ও হাদীছ বুঝার ক্ষেত্রে সালাফে ছালেহীন-এর বুঝকে উপেক্ষা করে নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা করা। নিম্নে তাদের অপব্যাখ্যার কিছু নমুনা জবাব সহ আলোচিত হ’ল।-

এক : আল্লাহ বলেন, هُوَ الَّذِيْ خَلَقَكُمْ فَمِنْكُمْ كَافِرٌ وَمِنْكُمْ مُؤْمِنٌ ‘তিনিই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তোমাদের কেউ কাফির এবং কেউ মুমিন’ (তাগাবুন ৬৪/২)। অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে কাফির ও মুমিন দু’ভাগে সীমাবদ্ধ করেছেন। আর ফাসিকরা মুমিন নয়। সুতরাং তারা কাফির।

জবাব : এ আয়াত দ্বারা মানুষকে কেবল দু’ভাগের মাঝে সীমাবদ্ধ করা হয়নি। কেননা আরও এক প্রকার মানুষ রয়েছে, তারা হ’ল পাপী। আর দু’প্রকার উল্লেখ করার কারণে বাকিগুলিকে অস্বীকার করা বুঝায় না। তাছাড়া এখানে বলা হয়েছে, কিছু মানুষ কাফির আর কিছু মুমিন। এর বাস্তবতা নিয়েও কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এটা বুঝায় না যে, পাপী মুমিনেরা কাফির যেমন দাবী করেছে খারেজীরা।

দুই : রাসূল (ছাঃ) বলেন,

لاَ يَزْنِى الزَّانِىْ حِيْنَ يَزْنِى وَهْوَ مُؤْمِنٌ، وَلاَ يَشْرَبُ الْخَمْرَ حِيْنَ يَشْرَبُ وَهْوَ مُؤْمِنٌ، وَلاَ يَسْرِقُ حِيْنَ يَسْرِقُ وَهْوَ مُؤْمِنٌ، وَلاَ يَنْتَهِبُ نُهْبَةً يَرْفَعُ النَّاسُ إِلَيْهِ فِيْهَا أَبْصَارَهُمْ وَهْوَ مُؤْمِنٌ ‘কোন ব্যভিচারী যখন ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, তখন সে মুমিন থাকে না। সে মুমিন থাকা অবস্থায় মদ পান করতে পারে না। সে মুমিন থাকা অবস্থায় চুরি করতে পারে না। ছিনতাইকারী যখন প্রকাশ্যে ছিনতাই করে, আর লোক অসহায় ও নিরূপায় হয়ে তার দিকে শুধু তাকিয়ে থাকে, তখন সে মুমিন থাকে না’।[37]

তারা এ হাদীছটি দ্বারা কবীরা গোনাহকারীকে ঈমান থেকে পুরোপুরি খারিজ দাবী করে।

জবাব : বিদ্বানগণ এ হাদীছের ব্যাখ্যায় বলেন, এখানে যে ব্যক্তি উল্লিখিত পাপগুলিকে হালাল মনে করে করবে তার ক্ষেত্রে এটি বলা হয়েছে। অথবা হাদীছে ঈমান দ্বারা পরিপূর্ণ ঈমানদার নয় বুঝানো হয়েছে। এ হাদীছে উল্লিখিত পাপের কারণে যদি দ্বীন থেকে খারিজ উদ্দেশ্য হ’ত, তাহ’লে তার জন্য শুধু ‘হদ’ জারি করাই যথেষ্ট মনে করা হ’ত না। এজন্যই যুহরী (রহঃ) এ ধরনের হাদীছ সম্পর্কে বলেন, ‘তোমরা এগুলিকে প্রয়োগ কর যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীগণ প্রয়োগ করতেন। অন্য হাদীছে এসেছে, আবু যার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যদি কোন বান্দা বলে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং এর উপরেই মৃত্যুবরণ করে, তাহ’লে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আমি বললাম, যদি সে যেনা করে এবং চুরি করে তবুও? তিনি বললেন, যদিও সে যেনা করে এবং চুরি করে। এভাবে আমি তিন বার বললাম, প্রত্যেকবার তিনি একই উত্তর দিলেন। চতুর্থবার বললেন, ‘যদিও আবু যারের নাক ভূলুণ্ঠিত হয়…’।[38]

তিন : মহান আল্লাহ বলেন,وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُوْنَ ‘যে সব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুযায়ী ফায়ছালা করে না তারা কাফির’ (মায়েদা ৫/৪৪)। তাদের দাবী এ আয়াত সকল প্রকার পাপীকে অন্তর্ভুক্ত করে। কেননা তারা আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুযায়ী ফায়ছালা করে না। সুতরাং তাদের কাফের হওয়া ওয়াজিব হয়ে যায়।

জবাবঃ অত্র আয়াতটি তাদের জন্য প্রযোজ্য, যারা আল্লাহর বিধানকে অস্বীকার করে এবং গায়রুল্লাহর বিধান দিয়ে ফায়ছালা করাকে বৈধ মনে করে। কিন্তু যে আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে এবং স্বীকার করে যে, তাঁর বিধান সত্য, তাহ’লে সে কাফির নয়, সে পাপী হিসাবে গণ্য হবে কুফরীর সুস্পষ্ট প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত। সারা পৃথিবীতে যখন মুসলিম উম্মাহ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। নেতৃত্বসহ নানাবিধ বিষয় নিয়ে শতধাবিভক্ত। এমনি করুণ মুহূর্তে এ বিদ‘আতী খারেজী দলের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। মুসলিম শাসকদের দোষ-ত্রুটির কারণে তাদেরকে কাফের, মুরতাদ ফৎওয়া দেওয়া এবং তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা খারেজীদের ধর্ম। এই বিষয়টি এত ধ্বংসাত্মক যে, আপনি প্রত্যেকটা আক্বীদার কিতাব খুলে দেখুন মুসলিম শাসকদের অন্যায় বা যুলুম-অত্যাচার সত্ত্বেও সৎকাজে তাদের প্রতি অনুগত থাকা এবং কোন মতেই বিদ্রোহ না করার কথা বলা হয়েছে।

চারঃ মহান আল্লাহ বলেন, ان الحكم إلا لله ‘আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম নেই’ (উইসুফ ৪০/৬৭)। খারেজীরা অজ্ঞতাহেতু এ আয়াতের অপব্যাখ্যা করে বলে, মানুষকে শালিস নিয়োগ করা কুরআন পরিপন্থী এবং কুফরী। এর জবাবে আলী (রাঃ) বলেছিলেন, كلمة حق أريد بها باطل ‘কথা সত্য, কিন্তু উদ্দেশ্য খারাপ’। কেননা মানুষের ফায়ছালা মানুষই করবে, আর তা হবে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী (নিসা ৪/৩৫; মায়েদা ৫/৯৫)।

খারেজী আক্বীদা বনাম আহলেহাদীছদের আক্বীদা :

কবীরা গোনাহগার সম্পর্কে : খারেজীদের মতে, মানুষ হয় মুমিন, নয় কাফির। একই বান্দার মাঝে ছওয়াব ও শাস্তি জমা হ’তে পারে না। তাই প্রত্যেক কবীরা গোনাহ কুফরী। আর কবীরা গোনাহগার কাফির। যে কোন মুসলিম কবীরা গোনাহ করলে তার সমস্ত নেক আমল বরবাদ হয়ে যায় এবং সে মুরতাদ হয়ে যায় ও কুফরীতে প্রবেশ করে। এ অবস্থায় অথবা একবার মিথ্যা বলে ছগীরা গোনাহ করে তওবা না করে মারা গেলে সে মুশরিক ও চিরস্থায়ী জাহান্নামী। যারা কবীরা গোনাহ করে তওবা করে না, তাদেরকে হত্যা করা তারা বৈধ মনে করে।

আহলেহাদীছদের আক্বীদা :

কবীরা গোনাহগার কাফের নয়। সে চিরস্থায়ী জাহান্নামীও নয়। তাকে হত্যা করাও জায়েয নয়। যদি সে তওবা না করে মারা যায়, তাহ’লে আল্লাহর ইচ্ছাধীন। তিনি তাকে ক্ষমাও করতে পারেন, আবার শাস্তিও দিতে পারেন। সে চিরস্থায়ী জাহান্নামীও নয়। বরং অপরাধের শাস্তি ভোগ করার পর আল্লাহর দয়ায় আবার সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। সে কবীরা গোনাহের কারণে অসম্পূর্ণ মুমিন অথবা ফাসেক। কিন্তু ঈমানের কারণে সে মুমিন। এটিই খারেজীদের চরমপন্থা এবং মু‘তাযিলা ও মুরজিয়াদের চরম শিথিলতার বিপরীতে মধ্যমপন্থী আক্বীদা। মহান আল্লাহ্ কবীরা গোনাহকারীদেরকে মুমিন হিসাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন,وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا ‘যদি মুমিনদের দুই দল যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তাহ’লে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিবে’ (হুজুরাত ৪৯/৯)। এ আয়াতের তাফসীরে হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন,

فسماهم مؤمنين مع الاقتتال، وبهذا استدل البخاري وغيره على أنه لايخرج عن الإيمان بالمعصية وإن عظمت، لا كما يقوله الخوارج ومن تابعهم.

‘পরস্পরে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তাদেরকে মুমিন নামকরণ করেছেন। এ আয়াত দ্বারা ইমাম বুখারী ও অন্যান্য বিদ্বানগণ দলীল গ্রহণ করেছেন যে, পাপের কারণে সে ঈমান থেকে বের হয়ে যায় না, যদিও পাপ বড় হয়। বিষয়টি এমন নয় যেমন খারেজী ও তাদের দোসররা বলে’।

ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,

فسمى الله هؤلاء مؤمنين مع مع ما وقع بينهم من القتال الذي يعد من أكبر الكبائر، ومن بين أنهم لم يحرجوا من الإيمان بالكلية.

‘তারা পরস্পরে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে যা সবচেয়ে বড় গোনাহের অন্তর্ভুক্ত, তবুও আল্লাহ তাদেরকে মুমিন নামকরণ করেছেন। এতদসত্ত্বেও তারা ঈমান থেকে পুরোপুরি বের হয়ে যায়নি। এজন্যই ইমাম মালেক (রহঃ) বলতেন,أهل الذنوب أي الكبائر مؤمنون مذنبون ‘কবীরা গোনাহকারীরা পাপী মুমিন’।

শাসক ও বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে : খারেজীদের মতে, কোন মুসলিম শাসক যদি তাদের মানহাজ না মানে অথবা ফাসেকী ও যুলুম করে, তাহ’লে তার জন্য ক্ষমতায় থাকা বৈধ নয়। এমন শাসকের আনুগত্য করাও জায়েয নয়। তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করা ওয়াজিব। তার অধীনে সরকারী চাকুরী, সরকারী বাসভবনে বসবাস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করা জায়েয নয়। তার অধীনস্থ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কর্মী ও আইন-শৃংখলা বাহিনীকে হত্যা করা জায়েয। তাদের মতে কোন মুসলিম বিচারক যদি আল্লাহর বিধান মতে বিচার না করেন, তাহ’লে তিনি অবশ্যই কাফের। তাকে হত্যা করা জায়েয, যদি তিনি তওবা না করেন।

আহলেহাদীছদের আক্বীদা : ইমাম ত্বাহাবী (রহঃ) বলেন, ‘আমীর ও শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাকে আমরা জায়েয মনে করি না, যদিও তারা যুলুম করে। আমরা তাদের অভিশাপও করি না, আনুগত্য হ’তে হাত গুটিয়ে নেই না। তাদের আনুগত্য আল্লাহর আনুগত্য সাপেক্ষে ফরয, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর অবাধ্যতার আদেশ দেয়। আমরা তাদের মঙ্গল ও কল্যাণের জন্য দো‘আ করব’।

কুরআন-সুন্নাহ সম্পর্কে : যে সকল সুন্নাত তাদের দাবী অনুযায়ী কুরআনের বাহ্যিক অর্থ বিরোধী মনে হয়, তারা তা অস্বীকার করে। ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, ‘তারা কুরআনের অপব্যাখ্যা করে’। তারা সুন্নাতকে প্রত্যাখ্যান করতঃ ব্যভিচারীকে রজম করার বিধান অস্বীকার করে।

আহলেহাদীছদের আক্বীদা :

কুরআন-সুন্নাহ দু’টিই অহী। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ألا إني أوتيت القرآن ومثله معه…‏ ‘জেনে রাখো! আমি কুরআন প্রাপ্ত হয়েছি ও তার ন্যায় আরেকটি বস্ত্ত’…।[39] হাদীছ কুরআনের ব্যাখ্যা স্বরূপ। মহান আল্লাহ্ বলেন,‎ وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُوْنَ‏ ‘আমরা আপনার নিকটে ‘যিকর’ নাযিল করেছি, যাতে আপনি লোকদের উদ্দেশ্যে নাযিলকৃত বিষয়গুলি তাদের নিকট ব্যাখ্যা করে দেন এবং যাতে তারা চিন্তা-গবেষণা করে’ (নাহ্ল ১৬/৪৪)। সুতরাং এ দু’য়ের মাঝে কোন বৈপরীত্য নেই।

নবী-রাসূলগণ সম্পর্কে : খারেজীদের কোন কোন দল নবী-রাসূলগণের দ্বারাও ছগীরা ও কবীরা গোনাহ সংঘটিত হওয়াকে জায়েয মনে করে। তাই তাদের মতে কোন নবীকেও কবীরা গোনাহের কারণে কাফের বলা যায়। যতক্ষণ না তিনি তওবা করে ফিরে আসেন (নাঊযুবিল্লাহ)। ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, ‘খারেজীরা রাসূল (ছাঃ)-এর ক্ষেত্রে যুলুম এবং তিনি তাঁর সুন্নাতের ক্ষেত্রে ভ্রষ্ট এমন অপবাদ আরোপ করা জায়েয করেছে। আর তাঁর আনুগত্য ও ইত্তেবা করা ওয়াজিব মনে করত না’। নবী-রাসূলগণ সম্পর্কে খারেজীদের এমন আক্বীদা কুফরীর শামিল।

ছাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে : তাদের মতে ছাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) কবীরা গোনাহ ও কুফরী করেছেন। তারা ওছমান (রাঃ)-কে কাফের ও মুরতাদ মনে করত এবং তাকে হত্যাকারীদের প্রশংসা করত। যেমন তারা আলী, মু‘আবিয়া, আমর ইবনুল আছ, আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) সহ যে সকল ছাহাবী শালিস নিয়োগ করাকে সমর্থন করেছেন তাদেরকে কাফের ও মুরতাদ ঘোষণা করতঃ তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিল।

আহলেহাদীছদের আক্বীদা :

ছাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে খারেজীদের যে আক্বীদা তা স্পষ্টত ফাসেকী। কেননা, ‘আল্লাহ তাদের উপর সন্তষ্ট তারাও তাঁর উপর সন্তুষ্ট’ (মায়েদা ৫/১১৯)। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা আমার ছাহাবীগণকে গালি দিও না। সেই সত্ত্বার কসম যার হাতে আমার প্রাণ, তোমাদের কেউ যদি ওহোদ পাহাড় সমপরিমাণ স্বর্ণ দান করে তবুও তা তাদের এক অঞ্জলি বা অর্ধাঞ্জলি দানের সমতুল্য হবে না।

পরকালে শাফা‘আত সম্পর্কে : তারা কবীরা গোনাহকারীর জন্য শাফা‘আতকে অস্বীকার করে। তাদের দাবী শাফা‘আত কেবল মুত্তাক্বীদের জন্য। তাদের মতে যাকে একবার জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে সে চিরস্থায়ী জাহান্নামী থাকবে।

আহলেহাদীছদের আক্বীদা :

খারেজীদের এমন আক্বীদা স্পষ্ট সুন্নাহ বিরোধী। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘আমার শাফা‘আত আমার উম্মতের মধ্যে যারা কবীরা গোনাহগার তাদের জন্য’।[40]

খারেজীদের বিধান :

দুনিয়াবী বিধান : খারেজীদের হুকুম সম্পর্কে বিদ্বানগণের ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া যায়। অনেকেই মনে করেন তারা কাফের। তাদের দলীল- যুল খুওয়াইছারার ঘটনা, তাদের দ্বীন থেকে বের হয়ে যাওয়া মর্মে বর্ণিত হাদীছ সমূহ এবং আলী, মু‘আবিয়া সহ প্রমুখ বিশিষ্ট ছাহাবীগণের সাথে তাদের ন্যক্কারজনক আচরণ। আবার অনেকেই বলেন, তারা ফাসিক ও বিদ‘আতী। কারণ কাউকে ইসলাম বহির্ভূত বলা সহজ বিষয় নয়। তবে স্পষ্ট কুফরী প্রমাণিত হ’লে তা ভিন্ন কথা। মোদ্দাকথা হ’ল, তাদের কথা, কর্ম ও আক্বীদার ভিত্তিতে তাদের ওপর হুকুম প্রযোজ্য হবে। শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, ‘তারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত হ’তে বহির্ভূত’। ইমাম শাতেবী (রহঃ) বলেন, ‘ফিরক্বা নাজিয়া ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের বিরোধিতা করায় তাদেরকে ভ্রষ্ট দল হিসাবে ধরা হয়’। সালাফে ছালেহীন যদিও তাদেরকে কাফের বলেন না। তবে তাদেরকে হাদীছে বর্ণিত ৭২টি ভ্রান্ত দলের একটি গণ্য করেন।

পরকালীন বিধান : রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘খারেজীরা জাহান্নামের কুকুর’।[41]

উপসংহার : খারেজীদের সম্পর্কে ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন,

إذ لو قووا هؤلاء لأفسدوا الأرض كلها عراقا وشاما، ولم يتركوا طفلا ولا ‏طفلة ولا رجلا ولا امرأة : لأن ‏الناس ‏عندهم قد فسدوا فسادا لا ‏يصلحهم ‏إلا القتل جملة.‏

‘যদি খারেজীরা শক্তিশালী হয় তথা ক্ষমতা পায়, তখন তারা ইরাক ও শামের সর্বত্র ফাসাদ সৃষ্টি (মুসলমানদেরকে তাকফীর ও হত্যা…ইত্যাদি) করে বেড়াবে। তারা কোন ছেলে শিশু, মেয়ে শিশু এবং নারী-পুরুষ কাউকে রেহাই দিবে না। কেননা তাদের আক্বীদা হ’ল, মানুষ এমনভাবে ফাসাদে লিপ্ত হয়েছে যে, তাদেরকে সামগ্রিকভাবে হত্যা করা ব্যতীত তারা সংশোধিত হবে না। খারেজীদের ভয়ানক রূপ সম্পর্কে ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন,

لم يكن أحد شرا على المسلمين منهم، لا اليهود ولا النصارى، فإنهم كانوا مجتهدين في قتل كل مسلم لم يوافقهم، مستحلين لدماء المسلمين وأموالهم، وقتل أولادهم، مكفرين لهم، وكانوا متدينين بذلك لعظم جهلهم وبدعتهم المضلة.

‘মুসলমানদের জন্য তাদের চাইতে ক্ষতিকর আর কেউ ছিল না। ইহুদীও নয়, নাছারাও নয়। কেননা যেসকল মুসলিম তাদেরকে সমর্থন করেনি, তারা তাদেরকে হত্যা করতে সদা তৎপর ছিল। মুসলমানদের রক্ত ও সম্পদ এবং তাদের সন্তানদেরকে হত্যা করা হালাল মনে করে তাদেরকে কাফের গণ্য করে। এরপরেও তাদের ব্যাপক অজ্ঞতা ও ভ্রষ্ট বিদ‘আত সত্ত্বেও তারা নিজেদেরকে দ্বীনদার মনে করত।

অতএব পথভ্রষ্ট খারেজী দল ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদা সমূহ থেকে বিরত থাকা প্রত্যেক মুমিনের জন্য আবশ্যক আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুণ-আমীন!

মীযানুর রহমান
লিসান্স; এম.এ (অধ্যয়নরত),
মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।‎

রেফারেন্স :

[1]. বুখারী হা/৩৬১০; মুসলিম হা/১০৬৪; মিশকাত হা/৫৮৯৪।

[2]. বুখারী হা/৭৪৩২; মুসলিম হা/১০৬৪; মিশকাত হা/৫৮৯৪।

[3]. মুসলিম হা/১০৬৩; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৮৭৮।

[4]. বুখারী হা/৬৯৩০; মিশকাত হা/৩৫৩৫।

[5]. বুখারী হা/৭৫৬২।

[6]. আবু দাউদ হা/৪৭৬৫; মিশকাত হা/৩৫৪৩, সনদ ছহীহ।

[7]. বুখারী হা/৩৬১১, ৫০৫৭, ৬৯৩৪; মুসলিম হা/২৪৬২, ২৪৬৯।

[8]. মুসলিম হা/২৪৬২; আবুদাঊদ হা/৪৭৬৭; আহমাদ হা/২০৪৪৬।

[9]. বুখারী হা/৫০৫৭।

[10]. বুখারী হা/৩৪১৫।

[11]. মুসলিম হা/২৪৬২।

[12]. বুখারী হা/২৪৬২।

[13]. আহমাদ হা/১২৯৭২; ইবনু আবী আছিম, আস-সুন্নাহ হা/৯৪৫; আলবানী একে ছহীহ বলেছেন, যিলালুল জান্নাহ হা/৯৪৫।

[14]. বুখারী হা/৩৬১০; মুসলিম হা/২৪৫১; ইবনু মাজাহ হা/১৫৭।

[15]. বুখারী হা/৩৬১০; মুসলিম হা/২৪৫১।

[16]. বুখারী হা/৩৬১০; মুসলিম হা/২৪৫১; আহমাদ হা/৭০৩৮; ইবনু আবী আছিম, আস-সুন্নাহ, হা/৯২৯-৯৩০।

[17]. আবুদাঊদ হা/৪৭৬৫; আহমাদ হা/১৩৩৩৮; মিশকাত হা/৩৫৪৩; আলবানী ছহীহ বলেছেন, ছহীহুল জামে‘ হা/৩৬৬৮।

[18]. আহমাদ হা/১২৯৭২; বায়হাক্বী, মাজমা যাওয়ায়েদ ২২৯/৬; আলবানী ছহীহ বলেছেন, যিলালুল জান্নাহ হা/৯৪৫।

[19]. আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া ৭/৩০৫।

[20]. আল-বিদায়া ১০/৫৮৭।

[21]. আলে-ইমরান ১০৬ নং আয়াতের তাফসীর, মুসনাদে আহমাদ হা/২২৩১৩।

[22]. বুখারী হা/৬৯৩৩।

[23]. বুখারী হা/৭১২৩।

[24]. বুখারী, হুজ্জাত কায়েম হওয়ার পর খাওয়ারেজ ও মুলহিদদের হত্যা করা অধ্যায়, ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত।

[25]. আবুদাঊদ হা/৪৭৬৯।

[26]. বুখারী হা/৩৪১৫।

[27]. আল-খাওয়ারিজ আক্বীদাতান ওয়া ফিকরান ৫৪-৬৮ পৃঃ।

[28]. আল-খাওয়ারিজ আউয়ালুল ফিরাক্ব ফী তারীখিল ইসলাম পৃঃ ৩৭-৩৮ ও ১৪৬।

[29]. ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২৭৯/৩৪৯, ৭/৩।

[30]. আল-মিলাল ওয়ান-নিহাল ১১৬/১।

[31]. মাকালাতুল ইসলামমিয়্যন ২০৪/১।

[32]. আশ-শারী‘আহ ২৮ পৃঃ।

[33]. দিরাসাতুন আনিল ফিরাক্ব ওয়া তারীখিল মুসলিমীন পৃঃ ১৩৪।

[34]. ইবনু মাজাহ হা/১৭৪; আলবানী হাসান বলেছেন, ছহীহুল জামে‘ হা/৮১৭২; আরনাঊত্ব ছহীহ বলেছেন, মুসনাদ ৩৯৮/৯।

[35]. ইবনু মাজাহ হা/১৭৪; আলবানী একে হাসান বলেছেন, ছহীহা হা/২৪৫৫।

[36]. মুসলিম হা/২৪৬৯, ২৪৫৭।

[37]. বুখারী হা/৬৭৭২; মুসলিম হা/৫৭; মিশকাত হা/৫৩।

[38]. বুখারী হা/৫৮২৭; মুসলিম হা/৯৪; মিশকাত হা/২৬।

[39]. আহমাদ হা/১৭২১৩।

[40]. আবু দাউদ হা/৪৭৩৯; ইবনু মাজাহ হা/৪৩১০; মিশকাত হা/৫৫৯৯, সনদ ছহীহ।

[41]. ইবনু মাজাহ হা/১৭৩, সনদ ছহীহ।

ইমাম মাহদির আগমন

ইমাম মাহদীর আগমন

সহীহ হাদীছের বিবরণ থেকে অবগত হওয়া যায় যে, আখেরী যামানায় ইমাম মাহদীর আত্মপ্রকাশ কিয়ামতের সর্বপ্রথম বড় আলামত। তিনি আগমণ করে এই উম্মাতের নের্তৃত্বের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন। ইসলাম ধর্মকে সংস্কার করবেন এবং ইসলামী শরীয়তের মাধ্যমে বিচার-ফয়সালা করবেন। পৃথিবী হতে জুলুম-নির্যাতন দূর করে ন্যায়-ইনসাফ দ্বারা তা ভরে দিবেন। উম্মতে মুহাম্মাদী তাঁর আমলে বিরাট কল্যাণের ভিতর থাকবে।
ইমাম ইবনে কাছীর (রঃ) বলেনঃ তখন ফল-ফলাদীতে প্রচুর বরকত হবে, মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি পাবে, ইসলাম বিজয়ী হবে, ইসলামের শত্রুরা পরাজিত হবে এবং সকল প্রকার কল্যাণ বিরাজ করবে।[1]
ইমাম মাহদীর পরিচয়ঃ
তাঁর নাম হবে আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামের মতই এবং তাঁর পিতার নাম হবে আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর পিতার নামের মতই। তিনি হবেন হাসান বিন আলী (রাঃ) এর বংশ থেকে।
ইবনে কাছীর (রঃ) বলেনঃ ‘‘তিনি হলেন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ আল-ফাতেমী আল-হাসানী’’।[2]
তাঁর আগমণের স্থানঃ
তিনি পূর্বের কোন একটি অঞ্চল থেকে প্রকাশিত হবেন। তবে পূর্ব দিক বলতে মদীনা মুনাওয়ারা হতে পূর্বের দিক বুঝানো হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘‘তোমাদের গুপ্তধনের নিকট তিনজন লোক ঝগড়া করবে। প্রত্যেকেই হবে খলীফার পুত্র। কেউ তা দখল করতে পারবেনা। অতঃপর পূর্বের দিক থেকে কালো পতাকাধারী একদল সৈনিক আসবে। তারা ব্যাপক হত্যাকান্ড চালাবে। হাদীছের বর্ণনাকারী বলেনঃ ‘‘এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন কিছু বিষয়ের কথা বর্ণনা করলেন যা আমি স্মরণ রাখতে পারিনি। তোমরা যখন তাদেরকে দেখতে পাবে তখন তাদের নেতার হাতে বায়আত করবে। যদিও বরফের উপর হামাগুড়ি দিয়ে উপস্থিত হতে হয়। কেননা তিনি হলেন আল্লাহর খলীফা মাহদী’’।[3]
ইমাম ইবনে কাছীর (রঃ) বলেনঃ ‘‘উল্লেখিত হাদীছে যে ধন-ভান্ডারের কথা বলা হয়েছে তা হল কা’বা ঘরের ধন-ভান্ডার। তিনজন খলীফার পুত্র তা দখল করার জন্য ঝগড়া করবে। কেউ তা দখল করতে পারবেনা। সর্বশেষে আখেরী যামানায় পূর্বের কোন একটি দেশ হতে মাহদী আগমণ করবেন। মূর্খ শিয়ারা সামেরার গর্ত হতে ইমাম মাহদী বের হওয়ার যে দাবী করে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। তারা আরো দাবী করে যে তিনি গর্তের মাঝে লুকায়িত আছেন। শিয়াদের একটি দল প্রতিদিন সে গর্তের কাছে দাঁড়িয়ে আপেক্ষা করে। এ ধরণের আরো অনেক হাস্যকর কাল্পনিক ঘটনা বর্ণিত আছে। এসমস্ত কথার পক্ষে কোন দলীল নেই; বরং কুরআন, হাদীছ এবং বিবেক বহির্ভূত কথা। তিনি আরো বলেনঃ পূর্বাঞ্চলের লোকেরা তাঁকে সাহায্য করবে এবং তাঁর শাসনকে সমর্থন করবে। তাঁরা কালো পতাকাধারী হবেন। মোটকথা আখেরী যামানায় পূর্বদেশ হতে তাঁর বের হওয়া সত্য। কা’বা ঘরের পাশে তাঁর জন্যে বায়আত করা হবে’’।[4]
• মাহদী আগমণের দলীলসমূহঃ
ইমাম মাহদীর আগমণের ব্যাপারে অনেক সহীহ হাদীছ রয়েছে। কোন কোন হাদীছে প্রকাশ্যভাবে তাঁর নাম উল্লেখ আছে। আবার কোন কোন হাদীছে তাঁর গুণাগুণ উল্লেখিত হয়েছে। তাঁর আগমণ সত্য হওয়ার জন্য এ সমস্ত হাদীছই যথেষ্ট।
১) আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণনা করেন, ‘‘আখেরী যামানায় আমার উম্মাতের ভিতরে মাহদীর আগমণ ঘটবে। তাঁর শাসনকালে আকাশ থেকে প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে, যমিন প্রচুর ফসল উৎপন্ন করবে, তিনি মানুষের মাঝে সমানভাবে প্রচুর সম্পদ বিতরণ করবেন, গৃহপালিত পশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং উম্মাতে মুহাম্মাদীর সম্মান বৃদ্ধি পাবে। তিনি সাত বছর কিংবা আট বছর জীবিত থাকবেন’’।[5]
২) আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে আরও বর্ণিত আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘‘আমি তোমাদেরকে মাহদীর আগমণ সম্পর্কে সুসংবাদ দিচ্ছি। মানুষেরা যখন মতবিরোধে লিপ্ত হবে তখন তিনি প্রেরিত হবেন। পৃথিবী হতে জুলুম-নির্যাতন দূর করে ন্যায়-ইনসাফ দ্বারা তা ভরে দিবেন। আসমান-যমীনের সকল অধিবাসী তার উপর সন্তুষ্ট হবেন। তিনি মানুষের মাঝে সমানভাবে প্রচুর সম্পদ বিতরণ করবেন’’।[6]
৩) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
الْمَهْدِيُّ مِنِّي أَجْلَى الْجَبْهَةِ أَقْنَى الْأَنْفِ يَمْلَأُ الْأَرْضَ قِسْطًا وَعَدْلًا كَمَا مُلِئَتْ جَوْرًا وَظُلْمًا يَمْلِكُ سَبْعَ سِنِينَ
‘‘মাহদী আসবেন আমার বংশধর হতে। তাঁর কপাল হবে উজ্জল এবং নাক হবে উঁচু। পৃথিবী হতে যুলুম-নির্যাতন দূর করে দিয়ে ন্যায়-ইনসাফ দ্বারা তা ভরে দিবেন। সাত বছর পর্যন্ত তিনি রাজত্ব করবেন’’।[7]
৪) উম্মে সালামা (রাঃ) বলেনঃ ‘‘আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ মাহদীর আগমণ হবে আমার পরিবারের ফাতেমার বংশধর হতে’’।[8]
৫) জাবের (রাঃ) বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ ঈসা (আঃ) যখন অবতরণ করবেন তখন মুসলমানদের আমীর তাঁকে বলবেনঃ আসুন! আমাদের নামাযের ইমামতি করুন। ঈসা (আঃ) বলবেনঃ বরং তোমাদের আমীর তোমাদের মধ্যে হতেই। এই উম্মতের সম্মানের কারণেই তিনি এ মন্তব্য করবেন’’।[9]
   ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম আল-মানারুল মুনীফ গ্রন্থে উক্ত হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। যেই আমীরের ইমামতিতে মুসলমানগণ নামায পড়বেন, তিন তাঁর নামও উল্লেখ করেছেন। আর তিনি হলেন মাহদী। এই হাদীছ সম্পর্কে ইবনুল কায়্যেম বলেনঃ হাদীছের সনদ খুব ভাল।[10]
৬) আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণনা করেনঃ ‘‘ঈসা ইবনে মারইয়াম যেই ইমামের পিছনে নামায পড়বেন তিনি হবেন আমাদের মধ্যে হতে’’।[11]
৭) নবী সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘‘ততদিন দুনিয়া ধ্বংস হবেনা যতদিন না আমার পরিবারের একজন লোক আরবদের বাদশা হবেন। তাঁর নাম হবে আমার নামে এবং তাঁর পিতার নাম হবে আমার পিতার নামের অনুরূপ’’।[12] অর্থাৎ তাঁর নাম হবে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ।
৮) উম্মে সালামা (রাঃ) বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ ‘‘কা’বা ঘরের পাশে একজন লোক আশ্রয় নিবে। তাঁর বিরুদ্ধে একদল সৈনিক প্রেরণ করা হবে। সৈন্যরা যখন ‘বায়দা’ নামক স্থানে পৌঁছবে তখন যমিন তাদেরকে গ্রাস করে ফেলবে। উম্মে সালামা বলেনঃ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম অপছন্দ সত্ত্বেও যারা তাদের সাথে যাবে তাদের অবস্থা কি হবে? উত্তরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ তাকে সহ যমিন ধসে যাবে। তবে কিয়ামতের দিন সে আপন নিয়তের উপরে পুনরুত্থিত হবে’’।[13]
৯) হাফসা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘‘অচিরেই এই ঘরের অর্থাৎ কা’বা ঘরের পাশে একদল লোক আশ্রয় গ্রহণ করবে। শত্রুর সাথে মোকাবেলা করার মত তাদের কোন উল্লেখযোগ্য সৈনিক কিংবা অস্ত্র-শস্ত্র বা প্রস্ত্ততি থাকবেনা। তাদেরকে হত্যা করার জন্য একদল সৈনিক প্রেরণ করা হবে। সৈন্যরা যখন ‘বায়দা’ নামক স্থানে পৌঁছবে তখন যমিন তাদেরকে গ্রাস করে ফেলবে’’।[14]
১০) আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ ‘‘একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘুমের ঘোরে এলোমেলো কিছু কাজ করলেন। আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ জাগ্রত হলে আমরা তাঁকে বললামঃ ঘুমের মধ্যে আপনি আজ এমন কিছু কাজ করেছেন যা অতীতে কখনও করেন নি। তিনি বললেনঃ আমার উম্মাতের একদল লোক কা’বার পাশে আশ্রয় গ্রহণকারী কুরাইশ বংশের একজন লোকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে। তারা যখন ‘বায়দা’ নামক স্থানে পৌঁছবে তখন তাদেরকে নিয়ে যমিন ধসে যাবে। আমরা বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! তখন তো রাস্তায় বিভিন্ন ধরণের লোক থাকবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ তাদের ভিতর এমন লোক থাকবে যারা নিজেদেরকে গোমরাহ জেনেও বের হবে, কাউকে বল প্রয়োগ করে আনা হবে এবং তাদের মধ্যে মুসাফিরও থাকবে। তারা সকলেই ধ্বংস হয়ে যাবে। তবে সকলকেই আল্লাহ তা’আলা নিয়তের উপর পুনরুত্থিত করবেন।[15]
   তাদেরকে নিয়তের উপর পুনরুত্থিত করার অর্থ তাদের কেউ জান্নাতে যাবে আবার কেউ জাহান্নামে প্রবেশ করবে। যারা নিজেদের ভ্রান্ত জেনেও উক্ত ইমামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বের হবে তারা জাহান্নামী হবে। আর যাদেরকে বাধ্য করে আনা হবে তাদের কোন অপরাধ হবেনা। এমনিভাবে পথিক ও পার্শ্ববর্তী স্থানের লোকেরাও উক্ত ভূমিধস থেকে রেহাই পাবেনা। কিন্তু সকল শ্রেণীর লোক নিজ নিজ আমল নিয়ে পুনরুত্থিত হবে।
  উপরের তিনটি হাদীছ থেকে জানা গেল যেই লোকটি কা’বার প্রান্তে আশ্রয় গ্রহণ করবেন তিনি হবেন কুরাইশ বংশের অন্তর্ভূক্ত। তিনি আল্লাহর সাহায্য প্রাপ্ত হবেন এবং তাঁর শত্রুদেরকে ভূমিধসের মাধ্যমে ধ্বংস করবেন।
• বুখারী ও মুসলিম শরীফে ইমাম মাহদী সম্পর্কিত কিছু হাদীছঃ
১) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
كَيْفَ أَنْتُمْ إِذَا نَزَلَ ابْنُ مَرْيَمَ فِيكُمْ وَإِمَامُكُمْ مِنْكُمْ
‘‘সেদিন কেমন হবে তোমাদের অবস্থা যেদিন তোমাদের মধ্যে ঈসা ইবনে মারইয়াম নেমে আসবেন এবং তোমাদের মধ্যে হতেই একজন ইমাম হবেন’’।[16] অর্থাৎ তোমাদের সাথে জামা’তে শরীক হয়ে ঈসা (আঃ) তোমাদের ইমামের পিছনে নামায আদায় করবেন।
২) জাবের (রাঃ) বলেনঃ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘‘আমার উম্মাতের একটি দল হকের উপর বিজয়ী থেকে কিয়ামত পর্যন্ত লড়াই করতে থাকবে। অতঃপর ঈসা ইবনে মারইয়াম অবতরণ করবেন। তাকে দেখে মুসলমানদের আমীর বলবেনঃ আসুন! আমাদেরকে নিয়ে নামাযের ইমামতি করুন। ঈসা (আঃ) বলবেনঃ না; বরং তোমাদের আমীর তোমাদের মধ্যে হতেই। এই উম্মাতের সম্মানের কারণেই তিনি এ মন্তব্য করবেন’’।[17]
৩) নবী সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘‘আখেরী যামানায় আমার উম্মাতের মধ্যে একজন খলীফা হবেন যিনি মানুষের মধ্যে মুক্ত হস্তে অগণিতভাবে ধন-সম্পদ বিতরণ করবেন’’।[18]
• মাহদী আগমণের ব্যাপারে কতিপয় বিজ্ঞ আলেমের বক্তব্যঃ
ক) হাফেয আবুল হাসান আল-আবেরী (রঃ) বলেনঃ ‘‘মাহদী সম্পর্কিত হাদীছগুলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে মুতাওয়াতির হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। তিনি আহলে বায়ত তথা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর বংশধরের অন্তর্ভূক্ত হবেন। সাত বছর রাজত্ব করবেন। তাঁর রাজত্বকালে পৃথিবী ন্যায়-ইনসাফে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। তাঁর রাজত্বকালে ঈসা ইবনে মারইয়াম (আঃ) আগমণ করে দাজ্জালকে হত্যা করবেন। ঈসা (আঃ) তাঁর পিছনে নামায পড়বেন’’।[19]
খ) ইমাম শাওকানী (রঃ) বলেনঃ ‘‘যতদূর জানা যায় মাহদীর ব্যাপারে ৫০টি মুতাওয়াতির হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে সহীহ, হাসান ও সামান্য ত্রুটি বিশিষ্ট হাদীছ, যা অন্য সূত্রে বর্ণিত হওয়ার কারণে ত্রুটিমুক্ত হয়ে গেছে। সুতরাং বিনা সন্দেহে হাদীছগুলো মুতাওয়াতির’’।[20]
গ) শায়খ আব্দুল আযীয বিন বায (রঃ) বলেনঃ মাহদীর বিষয়টি অতি সুস্পষ্ট। এ ব্যাপারে হাদীছগুলো মুতাওয়াতির[21] সূত্রে বর্ণিত। তাঁর আগমণ সত্য। তিনি হলেন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ আল-হাসানী আল-ফাতেমী। আখেরী যামানায় তিনি আগমণ করে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবেন। অন্যায়-অবিচার প্রতিহত করবেন। তাঁর মাধ্যমে আল্লাহ সত্য ও কল্যাণের ঝান্ডা বলুন্দ করবেন। যে ব্যক্তি আখেরী যামানায় ইমাম মাহদীর আগমণকে অস্বীকার করবে তার কথায় কর্ণপাত করা যাবেনা।[22]
ঘ) শায়খ আব্দুল মুহসিন আল-আববাদ বলেনঃ ‘‘২৬জন সাহাবী থেকে মাহদীর আগমণ সম্পর্কিত হাদীছগুলো বর্ণিত হয়েছে। ৩৬টি হাদীছ গ্রন্থে এ সমস্ত হাদীছ বর্ণিত হয়েছে’’।[23]
   উপরের আলোচনা থেকে আমরা জানতে পারলাম, ইমাম মাহদীর আগমণে বিশ্বাস স্থাপন করা ওয়াজিব। কারণ তাঁর আগমণের ব্যাপারে অনেক সহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। ঈসা ইবনে মারইয়াম (আঃ) যখন আকাশ থেকে অবতরণ করবেন তখন ইমাম মাহদীর নের্তৃত্বে মুসলমানগণ স্বসম্মান ও সুখণ্ডশান্তিতে বসবাস করতে থাকবেন। ইমাম মাহদী মুসলমানদেরকে নিয়ে নামাযের ইমামতি করার জন্য প্রস্ত্ততি নিতে থাকবেন। এমন সময় ঈসা ইবনে মারইয়াম (আঃ) আকাশ থেকে আগমণ করবেন। ইমাম মাহদী ঈসা (আঃ)কে দেখে বলবেনঃ সামনে অগ্রসর হোন এবং আমাদের ইমামতি করুন। হাদীছের ভাষ্য অনুযায়ী আরো জানা যায় যে, ইমাম মাহদীর সময় মুসলমানদের ঈমান ও শক্তি ধ্বংস করার জন্য দাজ্জালের আগমণ ঘটবে। দাজ্জালের মোকাবেলা করার জন্য আল্লাহ তাআলা ঈসা (আঃ) কে পাঠাবেন। ইমাম মাহদীও তাঁর সাথে মিলিত হয়ে দাজ্জালের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে তাকে এবং তার বাহিনীকে খতম করে মুসলমানদেরকে দাজ্জালের ফিতনা হতে মুক্ত করবেন।
ঙ) সিদ্দিক হাসান খান ভূপালী (রঃ) বলেনঃ ‘‘মাহদীর ব্যাপারে অনেক হাদীছ বিভিন্ন গ্রন্থে মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত হয়েছে’’।[24]
চ) সুনানে আবু দাউদ শরীফের ভাষ্যকার আল্লামা শামছুল হক আযীমাবাদী (রঃ) বলেনঃ ‘‘সর্ব যুগের সকল মুসলমানদের মাঝে একথা অতি প্রসিদ্ধ যে, আখেরী যামানায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর বংশধর হতে একজন সৎলোকের আগমণ ঘটবে। তিনি এই দ্বীনকে শক্তিশালী করবেন। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। মুসলমানগণ তাঁর অনুসরণ করবে। সমস্ত ইসলামী রাজ্যের উপর তাঁর আধিপত্য বিস্তার হবে। তাঁর নাম হবে মাহদী। তাঁর আগমণের পরেই সহীহ হাদীছে বর্ণিত কিয়ামতের অন্যান্য বড় আলামতগুলো প্রকাশিত হবে। তাঁর যামানাতেই ঈসা (আঃ) আগমণ করবেন এবং দাজ্জালকে হত্যা করবেন। এ ব্যাপারে মাহদীও তাঁকে সহযোগিতা করবেন।
উপরের বিস্তারিত আলোচনা থেকে ইমাম মাহদী সম্পর্কে আমরা যা অবগত হলাম তার সংক্ষিপ্ত কথা হল আখেরী যামানায় এই উম্মতের মধ্যে একজন সৎ লোক আগমণ করবেন। মাকামে ইবরাহীম এবং রুকনে ইয়ামানীর মধ্যবর্তী স্থানে মুসলমানগণ তাঁর হাতে বায়আত করবে। তাঁকে হত্যা করার জন্য সিরিয়া থেকে একদল সৈন্য প্রেরণ করা হবে। সৈন্যদলটি যখন মক্কার পথে ‘বায়দা’ নামক স্থানে পৌঁছবে তখন ভূমিধসে সকল সৈন্য হালাক হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা ইমাম মাহদীকে এভাবে তাঁর শত্রুদের হাত থেকে হেফাযত করবেন। তিনি মুসলমানদের খলীফা হয়ে ইসলামের মাধ্যমে বিচার-ফয়সালা করবেন। তাঁর যামানায় মুসলমানদের মাঝে চরম সুখণ্ডশান্তি ও নেয়া’মত বিরাজ করবে। অতঃপর তিনি দামেস্কের মসজিদে ফজরের নামাযের সময় ঈসা (আঃ)এর সাথে সাক্ষাৎ করবেন। প্রথমে তিনি ঈসা (আঃ) কে নামাযের ইমামতি করার অনুরোধ জানাবেন। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করলে স্বয়ং ইমাম মাহদী ইমামতি করবেন। ঈসা ইবনে মারইয়াম (আঃ) ইমাম মাহদীর পিছনে মুক্তাদী হয়ে নামায আদায় করবেন। অতঃপর তিনি ঈসা (আঃ) এর সাথে যোগ দিয়ে দাজ্জালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বের হবেন এবং দাজ্জাল হত্যার কাজে ঈসা (আঃ) কে সহায়তা করবেন। তারপর তিনি সাত বছর মতান্তরে নয় বছর পৃথিবীতে বসবাস করে মৃত্যু বরণ করবেন। মুসলমানগণ তাঁর জানাযা নামায পড়বে।
_______________________
[1] النهاية/ الفتن و الملاحم ( ১/ ৩১) –
[2] – নিহায়া, অধ্যায়ঃ আল-ফিতান ওয়াল মালাহিম।
[3] – ইবনে মাজাহ, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান। ইমাম আলবানী বলেনঃ ‘আল্লাহর খলীফা’ কথাটি ব্যতীত হাদীছের বাকী অংশ সহীহ।
[4] – (النهاية/ الفتن و الملاحم ( ১/২৯-৩০
[5] – মুস্তাদরাকুল হাকিম। ইমাম আলবানী (রঃ) হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন। সিলসিলায়ে সাহীহা, হাদীছ নং- ৭১১।
[6] – মুসনাদে আহমাদ। ইমাম হায়ছামী বলেনঃ হাদীছের বর্ণনাকারীগন নির্ভরযোগ্য। মাজমাউ য্ যাওয়ায়েদ (৭/৩১৩-৩১৪)।
[7] – আবু দাউদ, অধ্যায়ঃ কিতাবুল মাহদী, সহীহুল জামে আস্ সাগীর, হাদীছ নং- ৬৬১২।
[8] – আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ। ইমাম আলবানী (রঃ) সহীহ বলেছেন। সহীহুল জামেউ, হাদীছ নং- ৬৬১২।
[9] – আল-মানারুল মুনীফ, (পৃষ্ঠা নং-১৪৭-১৪৮) ইমাম ইবনুল কায়্যিম বলেনঃ হাদীছের সনদ ভাল।
[10] – আল-মানারুল মুনীফ, পৃষ্ঠা নং- ১৪৮।
[11]- আবু নুয়াইম আখবারুল মাহদী নামক গ্রন্থে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। সহীহুল জামে আস্-সাগীর, হাদীছ নং- ৫৭৯৬।
[12] – মুসনাদে আহমাদ, সহীহুল জামেউস্ সাগীর, হাদীছ নং- ৫১৮০।
[13] – মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।
[14] – মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।
[15] – মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।
[16] – বুখারী, অধ্যায়ঃ আহাদীছুল আম্বীয়া, মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ঈমান।
[17] – মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ঈমান।
[18] – মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।
[19] – تهذيب الكمال فى أسماء الرجال (৩ /১১৯৪)
[20] – نظم المتناثر من الحديث المتواتر (ص ১৪৫-১৪৬)
[21] – উসূলে হাদীছের পরিভাষায় মুতাওয়াতির ঐ হাদীছকে বলা হয় যার বর্ণনাকারীর সংখ্যা অধিক হওয়ার কারণে মিথ্যার উপর তাদের একমত হওয়ার কল্পনাও করা যায়না।
[22] – আশরাতুস্ সাআ, ডঃ আব্দুল্লাহ সুলায়মান আল-গুফায়লী, পৃষ্ঠা নং- ৮৭
[23] – الرد على من كذب بالأحاديث الصحيحة الواردة فى المهدى
[24] – الإذاعة لما كان و ما يكون بين يدى الساعة ص ১১২
_______________________________________________________________________________________
(বইঃ কিয়ামতের আলামত থেকে সংগৃহীত)
লেখক: শাইখ আব্দুল্লাহ বিন শাহেদ আল-মাদানী।
লিসান্স: মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, এম,এম, ফাস্ট ক্লাশ।
প্রকাশনায়: জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদী আরব।

যাকাত ও সদকা

যাকাত ও ছাদাক্বা
যাকাত ও ছাদাক্বা

যাকাত ও ছাদাক্বা

‘যাকাত’ অর্থ বৃদ্ধি পাওয়া, পবিত্রতা ইত্যাদি। পারিভাষিক অর্থে ঐ দান, যা আল্লাহর নিকটে ক্রমশঃ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং যাকাত দাতার মালকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে। ‘ছাদাক্বা’ অর্থ ঐ দান যার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ হয়। পারিভাষিক অর্থে যাকাত ও ছাদাক্বা মূলতঃ একই মর্মার্থে ব্যবহৃত হয়।

যাকাত ও ছাদাক্বার উদ্দেশ্য :
যাকাত ও ছাদাক্বার মূল উদ্দেশ্য হ’ল দারিদ্র্য বিমোচন ও ইসলামী ঐতিহ্য সংরক্ষণ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللهَ قّدْ فَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَاءِهِمْ فَتُرَدُّ عَلَى فُقَرَاءِهِمْ- ‘আল্লাহ তাদের উপরে ছাদাক্বা ফরয করেছেন। যা তাদের ধনীদের নিকট থেকে নেওয়া হবে ও তাদের গরীবদের মধ্যে ফিরিয়ে দেওয়া হবে’।১

যাকাতের প্রকারভেদ :
যাকাত চার প্রকার মালে ফরয হয়ে থাকে।
১. স্বর্ণ-রৌপ্য বা সঞ্চিত টাকা-পয়সা
২. ব্যবসায়রত সম্পদ
৩. উৎপন্ন ফসল
৪. গবাদি পশু। টাকা-পয়সা একবছর সঞ্চিত থাকলে শতকরা আড়াই টাকা বা ৪০ ভাগের ১ ভাগ হারে যাকাত বের করতে হয়। ব্যবসায়রত সম্পদ ও গবাদি পশুর মূলধনের এক বছর হিসাব করে যাকাত দিতে হয়। উৎপন্ন ফসল যেদিন হস্তগত হবে, সেদিনই যাকাত (ওশর) ফরয হয়। এর জন্য বছরপূর্তি শর্ত নয়।

যাকাতের নিছাব :
১. স্বর্ণ-রৌপ্যে পাঁচ উক্বিয়া বা ২০০ দিরহাম। ২. ব্যবসায়রত সম্পদ-এর নিছাব স্বর্ণ-রৌপ্যের ন্যায়। ৩. খাদ্য শস্যের নিছাব পাঁচ অসাক্ব, যা হিজাযী ছা‘ অনুযায়ী ১৯ মণ ১২ সেরের কাছাকাছি বা ৭১৭ কেজির মত হয়। এতে ওশর বা এক দশমাংশ নির্ধারিত। সেচা পানিতে হ’লে নিছফে ওশর বা ১/২০ অংশ নির্ধারিত। ৪. গবাদি পশু : (ক) উট ৫টিতে একটি ছাগল (খ) গরু-মহিষ ৩০টিতে ১টি দ্বিতীয় বছরে পদার্পণকারী বাছুর (গ) ছাগল-ভেড়া-দুম্বা ৪০টিতে একটি ছাগল।২

যাকাতুল ফিৎর :
এটিও ফরয যাকাত, যা ঈদুল ফিৎরের ছালাতে বের হওয়ার আগেই মাথা প্রতি এক ছা‘ বা মধ্যম হাতের চার অঞ্জলী (আড়াই কেজি) হিসাবে দেশের প্রধান খাদ্যশস্য হ’তে প্রদান করতে হয়। আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় উম্মতের ক্রীতদাস ও স্বাধীন, পুরুষ ও নারী, ছোট ও বড় সকলের উপর মাথা পিছু এক ছা‘ খেজুর, যব ইত্যাদি (অন্য বর্ণনায়) খাদ্যবস্ত্ত ফিৎরার যাকাত হিসাবে ফরয করেছেন এবং তা ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বেই আমাদেরকে জমা দেয়ার নির্দেশ দান করেছেন’। ছোট-বড়, ধনী-গরীব সকল মুসলিম নর-নারীর উপরে যাকাতুল ফিৎর ফরয। এর জন্য ‘ছাহেবে নিছাব’ অর্থাৎ সাংসারিক প্রয়োজনীয় বস্ত্তসমূহ বাদে ২০০ দিরহাম বা সাড়ে ৫২ তোলা রূপা কিংবা সাড়ে ৭ তোলা স্বর্ণের মালিক হওয়া শর্ত নয়।

ছাদাক্বা ব্যয়ের খাত সমূহ :
পবিত্র কুরআনে সূরায়ে তওবা ৬০নং আয়াতে ফরয ছাদাক্বা সমূহ ব্যয়ের আটটি খাত বর্ণিত হয়েছে। যথা-
১. ফক্বীর : নিঃসম্বল ভিক্ষাপ্রার্থী,
২. মিসকীন : যে ব্যক্তি নিজের প্রয়োজন মিটাতেও পারে না, মুখ ফুটে চাইতেও পারে না। বাহ্যিকভাবে তাকে সচ্ছল বলেই মনে হয়, ৩. ‘আমেলীন : যাকাত আদায়ের জন্য নিয়োজিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ,
৪. ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট ব্যক্তিগণ। অমুসলিমদেরকে ইসলামে দাখিল করাবার জন্য এই খাতটি নির্দিষ্ট,
৫. দাসমুক্তির জন্য। এই খাত বর্তমানে শূন্য। তবে অনেকে অসহায় কয়েদী মুক্তিকে এই খাতের অন্তর্ভুক্ত গণ্য করেছেন (কুরতুবী),
৬. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি : যার সম্পদের তুলনায় ঋণের অংক বেশী। কিন্তু যদি তার ঋণ থাকে ও সম্পদ না থাকে, এমতাবস্থায় সে ফক্বীর ও ঋণগ্রস্ত দু’টি খাতের হকদার হবে,
৭. ফী সাবীলিল্লাহ বা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা
৮. দুস্থ মুসাফির : পথিমধ্যে কোন কারণবশতঃ পাথেয় শূন্য হয়ে পড়লে পথিকগণ এই খাত হ’তে সাহায্য পাবেন। যদিও তিনি নিজ দেশে বা বাড়ীতে সম্পদশালী হন। ফিৎরা অন্যতম ফরয যাকাত হিসাবে তা উপরোক্ত খাত সমূহে বা ঐগুলির একাধিক খাতে ব্যয় করতে হবে। খাত বহির্ভূতভাবে কোন অমুসলিমকে ফিৎরা দেওয়া জায়েয নয়।৩

বায়তুল মাল জমা করা :
ফিৎরা ঈদের এক বা দু’দিন পূর্বে বায়তুল মালে জমা করা সুন্নাত। ইবনু ওমর (রাঃ) অনুরূপভাবে জমা করতেন। ঈদুল ফিৎরের দু’তিন দিন পূর্বে খলীফার পক্ষ হ’তে ফিৎরা জমাকারীগণ ফিৎরা সংগ্রহের জন্য বসতেন ও লোকেরা তাঁর কাছে গিয়ে ফিৎরা জমা করত। ঈদের পরে হকদারগণের মধ্যে বণ্টন করা হ’ত।৪

যাকাত-ওশর-ফিৎরা-কুরবানী ইত্যাদি ফরয ও নফল ছাদাক্বা রাষ্ট্র কিংবা কোন বিশ্বস্ত ইসলামী সংস্থা-র নিকটে জমা করা, অতঃপর সেই সংস্থা-র মাধ্যমে বণ্টন করাই হ’ল বায়তুল মাল বণ্টনের সুন্নাতী তরীকা। ছাহাবায়ে কেরামের যুগে এ ব্যবস্থাই চালু ছিল। তাঁরা কখনোই নিজেদের যাকাত নিজেরা হাতে করে বণ্টন করতেন না। বরং যাকাত সংগ্রহকারীর নিকটে গিয়ে জমা দিয়ে আসতেন। এখনও সঊদী আরব, কুয়েত প্রভৃতি দেশে এ রেওয়াজ চালু আছে।

১. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৭৭২ ‘যাকাত’ অধ্যায়।
২. বিস্তারিত নিছাব দ্রঃ ‘বঙ্গানুবাদ খুৎবা’ অধ্যায় দেখুন।
৩. ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৩৮৬; মির‘আৎ হা/১৮৩৩-এর ব্যাখ্যা, ১/২০৫-৬।
৪. দ্রঃ বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/১৫১১-এর আলোচনা, মির‘আৎ ১/২০৭ পৃঃ।

-আত-তাহরীক ডেস্ক

আমি কি সালাত আদায় করছি, এ সালাত কি আল্লাহ কবুল করবেন ?

k5557046-1.jpg

ছালাত ইসলামের দ্বিতীয় রুকন বা স্তম্ভ। পবিত্র কুরআনের প্রায় ৬৭টি স্থানে ছালাতের কথা বিভিন্নভাবে আলোচিত হয়েছে। পূর্ববতী নবী-রাসূলদের সকলেই ছালাত আদায় করতেন। এমনকি আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)এর উপর ছালাত ফরয হওয়ার আগেও তিনি দু‘রাকাত করে সকাল-সন্ধা ছালাত আদায় করতেন। কিন্তু উম্মতের উপর আমল হিসেবে আল্লাহ্‌ তা‘আলা সর্ব প্রথম যে ইবাদত ফরয করেন তা হচ্ছে ছালাত। ইসলামের প্রথম বাণী কালেমায়ে তাইয়্যেবা ‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ্‌’

এর পর প্রথম আদেশ ছিল ছালাতের। ছিল না যাকাত, ছিয়াম, হজ্জ বা কোন কিছুই।
এ ছালাত জিবরীল (আ:)এর মারফত ওহীর মাধ্যমে যমীনে ফরয হয়নি; বরং তা সপ্তাকাশে আরশে আযীমে ফরয করা হয়েছে। আল্লাহ্‌ তা‘আলা তাঁর প্রিয় হাবীব শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)কে নিজের কাছে ডেকে নেন। হয় ঐতিহাসিক মে’রাজ। আল্লাহ্‌ এবং তাঁর রাসূলের মাঝে সরাসরি কথোপকথোন হয়। আল্লাহ্‌ তা‘আলা রাসূলকে পঞ্চাশ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করার নির্দেশ দিয়ে প্রত্যার্পন করেন। কিন্তু ষষ্ঠাকাশে এসে মূসা (আ:)এর পরামর্শে তিনি ছালাতের সংখ্যা কমিয়ে দেয়ার জন্য আল্লাহ্‌র কাছে দরখাস্ত পেশ করেন। আল্লাহ্‌ তাঁর দরখাস্ত মুঞ্জর করে নির্ধারণ করেন পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত। কিন্তু বলে দিলেন, এই পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতে প্রদান করা হবে পঞ্চাশ ওয়াক্ত ছালাতের সমপরিমাণ ছওয়াব। (বুখারী ও মুসলিম থেকে সংক্ষেপে)

নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এই ছালাতকে যথাযথভাবে সম্পাদন করলেন, তার তাগিদ দিলেন, ছাহাবীদের তথা উম্মতকে শিক্ষা দান করলেন কিভাবে ছালাত আদায় করতে হয়। অতঃপর যখন তিনি সুমহান বন্ধু আল্লাহ্‌র ডাকে সাড়া দিয়ে ইহধাম ত্যাগ করলেন তখন মূমুর্ষু অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে যে উপদেশ প্রদান করলেন তা ছিল, ছালাত… ছালাত..। (মুসনাদে আহমাদ) সুতরাং দেখা যায় একজন মুমিনের জীবনের প্রথম কাজ হচ্ছে ছালাত এবং শেষ কাজও হচ্ছে ছালাত।
ছালাত বিহীন ব্যক্তিকে মু‘মিন হিসেবে কল্পনাও করা যায় না। অথচ মুসলিম সমাজে আজ সবচেয়ে বেশী গাফলতী, অনীহা ও অলসতা দেখা দেয় শুধুমাত্র ছালাতের ক্ষেত্রেই। একদল মানুষ ছালাত আদায় না করেই নিজেদেরকে পূর্ণ ঈমানদার মনে করে। আবার কিছু লোক নিজের খেয়াল খুশি মত ছালাত আদায় করে থাকে। মনে চাইলে আদায় করল, মনে চাইলে করল না- কখনো তিন ওয়াক্ত বা কখনো চার ওয়াক্ত। আবার কিছু লোক পাঁচ ওয়াক্তই আদায় করে কিন্তু তাদের ছালাত দেখে বুঝা যায় না যে তারা কোন ইবাদত করছে না খেলাধুলা করছে।

ছালাত না পড়লে কি হবে ঈমান ঠিক আছে!

একদল মানুষ খুব জোর গলায় উক্ত দাবী করে থাকে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে যদি তাদের মধ্যে ঈমান থাকতো তবে প্রমাণ স্বরূপ তারা ছালাত আদায় করতো। কেননা ঈমানের পরিচয়ই হল ছালাতে। যে ব্যক্তি এই ছালাত পরিত্যাগ করবে তার ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহ্‌তে ভয়াবহ পরিণতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

-আল্লাহ্‌ বলেন, (فَإنْ تاَبُوْا وَأقاَمُوا الصَّلاَةَ وآتَوا الزَّكاَةَ فَإخْواَنُكُم فِيْ الدِّيْنِ) “যদি তারা তওবা করে এবং ছালাত আদায় করে ও যাকাত প্রদান করে তবে তারা তোমাদের দ্বীনী ভাই।” (সূরা তওবা- ১১)

– আল্লাহ্‌ আরো বলেন, (ماَ سَلَقَكُمْ فِيْ سَقَرٍ، قاَلُوا لَمْ نَكُ مِنَ الْمُصَلِّيْنَ) “তোমাদেরকে কিসে সাক্বারে (জাহান্নামে) নিক্ষেপ করল? তারা বলবে, আমরা ছালাত আদায় করতাম না।” (সূরা মুদ্দাছ্‌ছির- ৪২)

– নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বলেন, (بَيْنَ الرَّجُلِ والْكُفْرِ والشِّرْكِ تَرْكُ الصَّلاَةِ) “মুসলিম বান্দা এবং কাফের ও মুশরিকের মধ্যে পার্থক্য হল ছালাত পরিত্যাগ করা।” (মুসলিম)

– তিনি আরো বলেন, (الْعَهْدُ الَّذِيْ بّيْنَناَ وَبَيْنَهُمْ الصّلاَةُ فَمَنْ تَرِكَهاَ فَقَدْ كَفَرَ) “তাদের মাঝে এবং আমাদের মাঝে চুক্তি হচ্ছে ছালাতের, যে ব্যক্তি ছালাত পরিত্যাগ করবে সে কাফের হয়ে যাবে।” (আহমাদ, আবূ দাঊদ)

– প্রখ্যাত ছাহাবী আবদুল্লাহ্‌ বিন শাক্বীক্ব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)এর ছাহাবীগণ ছালাত ব্যতীত কোন আমল পরিত্যাগ করার কারণে কাউকে কাফের মনে করতেন না।” (তিরমিযী) অর্থাৎ- কোন ব্যক্তি ছালাত ছেড়ে দিলে ছাহাবীগণ মনে করতেন সে কাফের হয়ে গেছে।

বিদ্যানদের অনেকেই ছালাত পরিত্যাগকারী কাফের হওয়ার ব্যাপারে ছাহাবায়ে কেরামের এজমা (ঐকমত্য) বর্ণনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে ওমর বিন খাত্তাব, আবদুর রহমান বিন আউফ, মু‘আয বিন জাবাল, আবু হুরায়রা, আবদুল্লাহ্‌ বিন মাসঊদ, আবদুল্লাহ্‌ বিন আব্বাস, জাবির বিন আবদুল্লাহ্‌, আবু দারদা প্রমূখ উল্লেখযোগ্য। (মুহাল্লা ইবনু হাযম সূত্র: নামায ত্যাগকারীর বিধান, ইবনু ঊছাইমীন পৃ:১৮)

ওমর বিন খাত্তাব (রা:) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ছালাত পরিত্যাগ করে ইসলামে তার কোন অংশ নেই।’ (মুআত্বা মালেক) অর্থাৎ- সে ইসলাম থেকে বের হয়ে গেছে। ইমাম ইসহাক বিন রাহ্‌ওয়াই বলেন, নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে নামায ত্যাগকারীর ব্যাপারে বিশুদ্ধ সূত্রে যেগুলো হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তাতে প্রমাণ হয় যে সে কাফের। আর এটাই হচ্ছে নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগ থেকে আজ পর্যন্ত আলেমগণের মত যে, ইচ্ছাকৃতভাবে বিনা কারণে নামাযের সময় অতিক্রম করে নামায ত্যাগকারী কাফের। (নামায ত্যাগকারীর বিধান, ইবনু ঊছাইমীন পৃ:১৮) ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রঃ) বেনামাযীর কাফের হওয়ার ব্যাপারে দশটি দিক উল্লেখ করেছেন। (শারহুল উমদাহ্‌, ইবনু তাইমিয়া২/ ৮১-৯৪) ইমাম ইবনুল ক্বাইয়েম (রঃ) বেনামাযী কাফের হওয়ার ব্যাপারে ২০টি দলীল উল্লেখ করেছেন। (কিতাবুছ্‌ ছালাত ১৭-২৬ পৃঃ)

শাইখ ইবনু ঊছাইমীন (রঃ) নামায ত্যাগকারীকে কাফের ও মুরতাদ হিসেবে উল্লেখ করে, তার জন্য নিম্ন লিখিত বিধান সমূহ উল্লেখ করেনঃ

১) বেনামাযী কোন মসুলিম মেয়ের অভিভাবকত্ত করতে পারবে না।

২) সে নিকটাত্মীয়দের মীরাছ থেকে বঞ্চিত হবে।

৩) তার যবেহকৃত প্রাণীর মাংস খাওয়া হারাম।

৪) সে মক্কা ও তার হারাম এলাকায় প্রবেশ করতে পারবে না।

৫) তার জানাযা পড়া, মাগফিরাত ও রহমতের জন্য দু‘আ করা হারাম।

৬) কোন মুসলিম মেয়েকে তার সাথে বিবাহ দেয়া হারাম। (নামায ত্যাগকারীর বিধান, ইবনু ঊছাইমীন পৃ: ২৪- ৩৬)

সুতরাং ওহে নামাযত্যাগী সাবধান! আল্লাহ্‌কে ভয় করুন, তাঁর হক্ব আদায় করুন। দুনিয়া ও আখেরাতে সৌভাগ্যশালীদের অন্তর্ভূক্ত হোন।
ছালাত আদায় না করে অন্যান্য নেক আমল যত বেশীই করা হোক না কেন তাতে কোন ফায়দা নেই। কেননা যে ব্যক্তির ছালাত ঠিক নেই তার অন্য কোন আমলের মূল্য নেই। রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বলেন,(إنَّ أوَّلَ ماَ يُحاَسَبُ بِهِ الْعَبْدُ يَوْمَ الْقِياَمَةِ الصَّلاَةُ، فإن صَلَحَتْ صَلَحَ سَائِرُ عَمَلِهِ وَإنْ رُدَّتْ رُدَّ ساَئِرُ عَمَلِهِ) “ক্বিয়ামত দিবসে বান্দার সর্বপ্রথম যে আমলের হিসাব নেয়া হবে তা হচ্ছে ছালাত। যদি ছালাত গ্রহণীয় হয় তবে সমস- আমল গ্রহণীয় হবে। আর ছালাত যদি প্রত্যাখ্যাত হয় তবে যাবতীয় আমল প্রত্যাখ্যাত হবে।” (হাসান সনদে ত্ববরাণী, ছহীহ্‌ জামে ছগীর)
ছালাত ব্যতীত জান্নাতের আশা করা কল্পনা মাত্র। কেননা নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বলেন, ক্বিয়ামত দিবসে জান্নাতীদের জান্নাতে এবং জাহান্নামীদের জাহান্নামে দেয়ার পর আল্লাহ্‌ তা‘আলা স্বীয় করুণায় কিছু সংখ্যক লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করার জন্য ফেরেস্তারকে আদেশ করবেন- যারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্‌ পাঠ করেছে এবং আল্লাহ্‌র সাথে কোন কিছুকে শির্ক করেনি। তখন ফেরেস্তাগণ তাদেরকে চিনতে পারবে তাদের সিজদাহ্‌র স্থান দেখে। কেননা আল্লাহ্‌ তা‘আলা আদম সন্তানের সিজদা করার অংগগুলোকে জ্বালানো আগুনের জন্য হারাম করে দিয়েছেন। তারপর তারা সেই সমস্ত সিজদাকারী লোকদেরকে তাদের সিজদার চিহ্ন দেখে জাহান্নাম থেকে বের করবেন। (বুখারী ও মুসলিম) এদ্বারা বুঝা যায় বেনামাযীর সিজদার কোন চিহ্ন থাকবে না, সুতরাং তাদের জাহান্নাম থেকে বের হওয়ারও কোন সম্ভাবনা নেই।
এই কারণে বেনামাযী ব্যক্তি ক্বিয়ামত দিবসে জাহান্নামে পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বাধিক নিকৃষ্ট ব্যক্তিদের সাথে বসবাস করবে। আবদুল্লাহ্‌ বিন আমর বিন আ‘ছ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) ছালাতের কথা বলতে গিয়ে এরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি ছালাতের হেফাযত করবে তার জন্য তা ক্বিয়ামত দিবসে জ্যোতি, প্রমাণ ও মুক্তি স্বরূপ হবে। আর যে ব্যক্তি তা হেফাযত করবে না (যথাযথভাবে আদায় করবে না) তা তার জন্য জ্যোতি, প্রমাণ ও মুক্তি হবে না। বরং ক্বিয়ামতের দিন সে কারূন, ফেরআউন, হামান ও উবাই ইবনু খালাফের সাথে অবস্থান করবে।” (মুসনাদে আহমাদ)

মুনাফেক ব্যক্তির ছালাতঃ

যারা লোক দেখানোর জন্য ছালাত আদায় করে বা কিছু ছালাত আদায় করে কিছু করে না তাদের ছালাত মুনাফেকের ছালাতের ন্যায়।
মুনাফেকগণ ছালাত থেকে পিছনে থাকে। ছালাত তাদের নিকট ভারী ও কষ্টকর মনে হয়। সুযোগ পেলে ছালাত আদায় করে, সুযোগ না পেলে করে না। আল্লাহ্‌ পবিত্র কুরআনে মুনাফেকদের ছালাতের একটি চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, (إنَّ الْمُناَفِقِيْن يُخاَدِعُوْنَ اللهَ وَهُوَ خاَدِعُهُمْ، وإذاَ قاَمُوْا إلَى الصَََلاَةِ قاَمُوْا كُسَالَى، يُراَؤُونَ الناَّسَ وَلاَ يَذْكُرُوْنَ اللهَ إلاَّ قَلِيْلاً) “নিশ্চয় মুনাফেকরা আল্লাহ্‌কে ধোকা দেয়ার চেষ্টা করে অথচ তিনিই তাদেরকে ধোকা দিবেন (অর্থাৎ- তাদের ধোকাবাজির শাসি- দিবেন।) তারা যখন ছালাতে দন্ডায়মান হয় তখন অলস ভঙ্গিতে দন্ডয়মান হয়। তাদের উদ্দেশ্য মানুষকে দেখানো। আর তারা খুব অল্পই আল্লাহ্‌কে স্মরণ করে থাকে।” (সূরা নিসা- ১৪২)
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বলেন, (لَيْسَ صَلاَةٌ أثْقَلَ عَلىَ الْمُناَفِقِيْنَ مِنْ صَلاَةِ الْفَجْرِ وَالعِشاَءِ وَلَوْ يَعْلَمُوْنَ ماَ فِيْهِماَ لأَتَوْهُماَ وَلَوْ حَبْواً) “মুনাফিক্বদের উপর এশা ও ফজর ছালাতের চাইতে এমন কষ্টকর কোন ছালাত নেই। তারা যদি জানতো এ দু‘ছালাতে কি প্রতিদান রয়েছে তবে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তাতে উপস্থিত হত।” (বুখারী ও মুসলিম)
শুধু তাই নয় ইচ্ছাকৃতভাবে দেরী করে ছালাত আদায়কারীকেও হাদীছে মুনাফিক বলা হয়েছে। আনাস বিন মালেক (রা:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি শুনেছি রাসূলুল্লাহ্‌ বলেন, “ঐটা মুনাফেকদের ছালাত ঐটা মুনাফেকদের ছালাত ঐটা মুনাফেকদের ছালাত। যে কিনা ইচ্ছাকৃতভাবে বসে থাকে। সূর্য (অস্ত যাওয়ার পূর্বে) যখন হলুদ বর্ণ ধারণ করে এবং শয়তানের দু‘শিংয়ের মাঝে অবস্থান করে তখন সে চারটি ঠোকর মারে (চার রাকাত ছালাত আদায় করে) আর তাড়াহুড়ার কারণে তাতে খুব অল্পই আল্লাহ্‌কে স্মরণ করে থাকে।” (আহমাদ, আবু দাঊদ, মালেক)

মুছল্লী কিন্তু জাহান্নামী!

কোন রকম ছালাত আদায় করলেই কি পার পাওয়া যাবে? ছালাত আদায় করতে হয় তাই করলাম। সময়ের প্রতি গুরুত্ব নেই, পদ্ধতি খেয়াল-খুশি মত। এ ধরণের মুছল্লীর পরিণতি যে কত ভয়াবহ, তার স্বাক্ষ্য পবিত্র কুরআনে পাওয়া যায়। আল্লাহ্‌ তা‘আলা এরশাদ করেন, (فَوَيْلٌ لِّلْمُصَلِّيْنَ، الَّذِيْنَ هُمْ عَنْ صَلاَتِهِمْ ساَهُوْنَ) “মুছল্লীদের জন্য রয়েছে দুর্ভোগ। যারা ছালাত থেকে উদাসীন।” (সূরা মাঊন ৪-৫) এ আয়াতের তাফসীরে সা‘দ বিন আবী ওয়াক্কাস (রা:) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)কে জিজ্ঞেস করা হল, তারা কারা যাদের জন্য রয়েছে দুর্ভোগ? তিনি বললেন, “যারা ছালাতের নির্দিষ্ট সময় পার করে দিয়ে ছালাত আদায় করে।” সুতরাং সাবধান হে মুছল্লী ভায়েরা! আমরা যেন এরকম না হই যে, ছালাতও আদায় করলাম এবং জাহান্নামেরও অধিবাসী হলাম!। (আল্লাহ্‌ আমাদের সাহায্য করুন।)

পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করলেই কি নাজাত পেয়ে যাবে?

আমরা যারা যথারীতি পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করি তারা কি নিশ্চিত যে, আমরা এ ছলাতের মাধ্যমে মুক্তি পেয়ে যাব? জান্নাতে চলে যাব? মু‘মিন ব্যক্তি এরকম নিশ্চয়তা নিয়ে বসে থাকবে না; বরং সে ভয়-ভীতি ও আশা-আকাংখ্যা নিয়ে ইবাদত করবে- ছালাত আদায় করবে। কেননা, আমরা যে ছালাত আদায় করি, আলাদা ভাবে তার হিসেব নেয়া হবে। সত্যিকারভাবে আমরা আল্লাহ্‌র জন্য ছালাত আদায় করেছি না লোক দেখানোর জন্য করেছি তা সেদিন সুস্পষ্ট হয়ে যাবে। সে দিন ফাঁকি দেয়ার কোন অবকাশ থাকবে না। কেননা, হৃদয়ের গোপন উদ্দেশ্যের মালিক আল্লাহ্‌ তা‘আলা। যা বাইরে থেকে কারো দেখা বা বুঝার উপায় নাই।
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, … অতঃপর সেদিন মহান আল্লাহ্‌ স্বীয় পায়ের পর্দা উম্মোচন করবেন, তখন প্রত্যেক মু‘মিন ব্যক্তি যারা পৃথিবীতে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ্‌কে সিজদাহ্‌ করেছিল তাদেরকে অনুমতি দেয়া হবে- তারা আল্লাহ্‌র জন্য সিজদায় লুটিয়ে পড়বে। আর যারা মানুষকে দেখানোর জন্য, মানুষের প্রশংসা কুড়ানোর উদ্দেশ্যে ছালাত আদায় করেছিল তারা সিজদাহ্‌ করতে পারবে না। তাদের পৃষ্ঠদেশ শক্ত হয়ে যাবে- বাঁকা হবে না। যখনই তারা সিজদাহ্‌ করার ইচ্ছা করবে তখনই পিছনের দিকে চিৎ হয়ে উল্টে পড়ে যাবে।” (বুখারী ও মুসলিম) আল্লাহ্‌ বলেন, (يَوْمَ يُكْشَفُ عَنْ ساَقٍ وَّيُدْعَوْنَ إلَى السُّجُوْدِ فَلاَ يَسْتَطِيْعُوْنَ) “সেদিন পায়ের নলা থেকে পর্দা উম্মোচিত করা হবে এবং তাদেরকে সিজদা করার জন্য আহবান করা হবে কিন’ তারা সিজদা করতে সক্ষম হবে না।” (সূরা ক্বলম- ৪২) সুতরাং প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য অতি আবশ্যক প্রচেষ্টা হচ্ছে, নিজ ছালাতকে শয়তানের প্ররোচনা থেকে রক্ষা করা, লোক দেখানো ও শ্রুতির নিয়ত পরিত্যাগ করা।
হে আল্লাহ্‌! আমাদেরকে এবং আমাদের সন-ানদেরকে ছালাত প্রতিষ্ঠাকারী বানাও। তোমার সন’ষ্টির উদ্দেশ্যে আমাদেরকে ছালাত আদায় করার তাওফীক দাও। হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের দু‘আ কবূল কর। আমীন॥

সংকলনঃ
মুহা: আবদুল্লাহ্‌ আল কাফী
দাঈ, জুবাইল দাওয়া এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সঊদী আরব।
পোঃ বক্স নং ১৫৮০, জুবাইল- ৩১৯৫১
ফোনঃ ০৩-৩৬২৫৫০০ এক্স, ১০১১, ১০১৪ ফ্যাক্সঃ ৩৬২৬৬০০। মোবাইল: ০৫০১৮৪৭৬৪৬
Email: mohdkafi12@yahoo.com

هل أصلي؟

جمع وترتيب: محمد عبد الله الكافي

الداعية بالمكتب التعاوني للدعوة والإرشاد وتوعية الجاليات بمحافظة الجبيل

আহলে হাদীস নাম কী ইংরেজ কর্তৃক বরাদ্দকৃত?

আহলে হাদীস নাম কী ইংরেজ কর্তৃক বরাদ্দকৃত?

লেখক: আব্দুল্লাহ মাহমুদ

৯৩ হিজরীতে মুহাম্মাদ বিন কাসিম কর্তৃক সিন্ধ বিজয়ের মাধ্যমে ভারতবর্ষে মুসলমানদের রাজত্ব শুরু হলেও তার পূর্বে অনেক সাহাবী ও তাবেয়ী ব্যক্তিগতভাবে ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচার করেছেন।তাদের মাধ্যমে অসংখ্য লোক ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়।কমপক্ষে ২৫ জন সাহাবী ও ৪০ এর অধিক তাবেয়ীর পদরেণুতে উপমহাদেশের মাটি ধন্য হয়েছে।আর তখন থেকেই আহলে হাদীসের পাদচারণা উপমহাদেশের বুকে।

এর প্রমানসরূপ আমরা শুধুমাত্র প্রখ্যাত ভূ-পর্যটক শামসুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন আহমাদ আল-মাক্বদেসী একটা উদ্ধৃতি নকল করছি।তিনি ৩৭৫ হিজরীতে ভারতের তৎকালীন ইসলামী রাজধানী সিন্ধুর মানসূরায় আসেন।মানসূরা (করাচী) সম্পর্কে তিনি বলেন:أكثرهم اصحاب الحديث
অর্থাৎ সেকানকার অধিকাংশ মুসলিম অধিবাসী আহলে হাদীস। তিনি আরো বলেন, ক্বাজী আবূ মুহাম্মাদ মানসূরী নামে সেখানে দাউদী মাযহাবের একজন ইমাম আছেন।তার লিখিত অনেক মূল্যবান কিতাবাদি রয়েছে।মুলতানের অধিবাসীরা শি’আ মতাবলম্বী। প্রত্যেক শহরে কিছু কিছুই হানাফী ফকীহ আছেন।এখানে মালেকী বা মু’তাযেলী কেউ নেই,হাম্বালীও নেই।(আহসানুত তাকাসীম ৪৮১,আহলে হাদীস কী ও কেন ২৮ এর উদ্ধৃতিতে)

এখানে বেশ কয়েকটা জিনিস প্রমাণিত হয়:

১) আহলে হাদীস শব্দ অন্যান্য মাযহাবের বিপরীতে ব্যবহার করা হয়েছে।যা প্রমাণ করে আহলে হাদীস স্বতন্ত্র এক মাসলাকের নাম।যার মাঝে জনসাধারণও শামিল।
২) আহলে হাদীস দ্বারা যে জনসাধারণ উদ্দেশ্য তা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হচ্ছে। কেননা একটি রাজধানীর অধিকাংশ মানুষ মুহাদ্দিস হওয়া অসম্ভব।
৩) ইংরেজদের বহুকাল পূর্বে উপমহাদেশে আহলে হাদীসের অস্তিত্ব ছিল।
৪) আহলে হাদীস নাম ইংরেজরা দেয়নি। কারণ ৩৭৫ হিজরীতে তাদের কোনো অস্তিত্ব ছিলনা ভারতীয় উপমহাদেশে।
অতএব প্রমাণিত হয়, ইংরেজদের বহুকাল পূর্ব থেকে ভারত উপমহাদেশে আহলে হাদীসের অস্তিত্ব ছিল এবং তারা আহলে হাদীস নামই তাদের পরিচয়ে ব্যবহার করতো। তাই একথা বলার কোনো সুযোগই নাই যে,আহলে হাদীস নাম ইংরেজরা রাখে,উপমহাদেশে আহলে হাদীসের কোনো অস্তিত্বই ছিলনা ইংরেজদের পূর্বে।

কিন্তু আফসোস! একটি গোষ্ঠী আহলে হাদীসের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও নিজেদের মাঝে জমিয়ে রাখা বিষ উদগীরণ করতে গিয়ে বলে আহলে হাদীস নাম ইংরেজরা দিয়েছে।ইতিপূর্বে এ নাম ছিলনা। তাদের এ দাবীর বাতুলতা প্রমাণের জন্য উপরে উল্লেখিত আল-মাক্বদেসীর বক্তব্যই যথেষ্ট।

তারা তাদের দাবীর পক্ষে আল্লামাহ হুসাইন আহমাদ বাটালাভী রহিমাহুল্লাহর একটি চিঠির উদ্ধৃতি প্রদান করে থাকে।আমরা উক্ত চিঠির সে অংশটুকু উল্লেখ করব, যা তারা তাদের দাবীর পক্ষে পেশ করে থাকে।

…..اس فرقہ کے حق میں استعمال لفظ وہابی سرکاری خط و کتابت میں موقوف کیا جاوے اور اھل نام سے مخاطب کیاجائے
সুতরাং এ দলের লোকজনের বেলায় এ শব্দের (ওয়াহাবী, প্রবন্ধকারের পক্ষ থেকে) ব্যবহারের উপর খুবই আপত্তি করণ এবং পূর্ণ সম্মান ও বিনয়ের সাথে সরকারের নিকট আবেদন করে যে, যেন সরকারীভাবে (হিতাকাঙ্খী ও নিমক হালালের প্রেক্ষিতে, বইয়ের অনুবাদকের পক্ষ থেকে) এ শব্দটি নিষিদ্ধ করে তার ব্যবহার অবৈধ ঘোষণা করা হোক এবং তাদেরকে আহলে হাদীস নামে সম্বোধন করা হউক।………..এই দলের ব্যাপারে ওয়াহাবী শব্দের ব্যবহার সরকারী চিঠিপত্রে বন্ধ করা হোক এবং আহলে হাদীস নামে সম্বোধন করা হোক (এই অনুবাদ হানাফী কিতাব ‘তাকলীদের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা’ মূল লেখক, প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মাসউদ আহমাদ, ভাষান্তর, মাওলানা হারুন ইযহার, প্রকাশক, মুহাম্মদ আবু তৈয়ব চৌধুরী, প্রকাশকাল, ১৫ এপ্রিল ২০১১, পৃষ্ঠা ৬৩ থেকে নেয়া হয়েছে।)

হানাফী কিতাব ‘তাকলীদের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা’তে স্যার সৈয়দ আহমাদ থেকে একটি বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে।তা নিম্নরূপ-
মৌলভী মুহাম্মদ হোসাইন সরকারকে আবেদন করে যে,এই ফিরকাটি যারা প্রকৃতপক্ষে আহলে হাদীস, সরকার যেন তাদেরকে ওয়াহাবী নামে সম্বোধন না করে। মৌলভী মুহাম্মদ হোসাইনের প্রচেষ্টায় সরকার তা অনুমোদন করে।যেন আগামীতে সরকার লেখা-লেখিতে এই দলটিকে ওহাবী শব্দের স্থলে আহলে হাদীস নামে উল্লেখ করে। (‘তাকলীদের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা’ মূল লেখক, প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মাসউদ আহমাদ, ভাষান্তর, মাওলানা হারুন ইযহার, প্রকাশক, মুহাম্মদ আবু তৈয়ব চৌধুরী, প্রকাশকাল, ১৫ এপ্রিল ২০১১, পৃষ্ঠা ৬৪)

আমরা উপরে হানাফী কিতাবের উদ্ধৃতিতে দেখলাম আল্লামাহ হুসাইন আহমাদ বাটালাভী রহিমাহুল্লাহ সরকারকে এমর্মে চিঠি লিখেননি যে, আপনারা গোটা দেশে এ হুকুম জারি করেন যে, আজ থেকে আমাদের ওয়াহাবী নামে ডাকা যাবেনা,আমাদেরকে আহলে হাদীস নামে ডাকতে হবে এবং আপনারা আমাদের নাম রাখুন ‘আহলে হাদীস’। শুধুমাত্র তিনি এমর্মে চিঠি লিখেন যে,যেন সরকারী চিঠিপত্রে ওয়াহাবী লেখা না হয়।ওয়াহাবী শব্দের স্থানে যেন আহলে হাদীস ব্যবহার করা হয়।অতএব যারা প্রচার করে বেড়ায় ইংরেজরা আহলে হাদীস নাম দেয় তারা মূলত সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে মিথ্যার আশ্রয় নেয়।

ইংরেজ সরকার আল্লামাহ হুসাইন আহমাদ বাটালাভী রহিমাহুল্লাহর উক্ত চিঠির উত্তরও তাকে দেয়।আমরা এখন সেই উত্তর পাঠকদের সামনে তুলে ধরব।কেননা সেই উত্তর এই মিথ্যাচারের অট্টালিকাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট করে দিবে আহলে হাদীস নাম ইংরেজ কর্তৃক দেয়া কোনো নাম নয়। প্রথম উত্তর হচ্ছে ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি ইন্ডিয়া গভর্নমেন্ট-এর পক্ষ থেকে পাঞ্জাবের সেক্রেটারি বরাবর।

Dated 3rd December 1886

From the officiating Secretary to the government of India, Home Department,
To the Secretary of the Punjab.

In reply to your letter No 1044 of the 8th June last, I am directed to say that the Governor General in council issued expresses his concurrence with the views of sir Charles Aithison that the use of the term Wahhabi should be discontinued in official correspondence.
তারিখ ৩ ডিসেম্বর ১৮৮৬
ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি ভারত সরকার, স্বরাষ্ট্র অধিদপ্তর-এর পক্ষে থেকে
পাঞ্জাব সেক্রেটারি বরাবর।
আপনার চিঠি নাম্বার ১০৪৪, তারিখ ৮ জুন ১৮৮৬-এর জবাবে আমাকে বলতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে,গভর্নর জেনারেল কাউন্সিলের জারিতে স্যার চার্লস ইচিসন এর সাথে এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেছে যে,আগামীতে সরকারী চিঠিপত্রে “ওয়াহাবী” নামের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।

এবার দেখুন ২য় উত্তর যা আল্লামাহ হুসাইন আহমাদ বাটালাভী রহিমাহুল্লাহকে পাঠান হয়।

From U.M. Young, Secretary to the Government of Punjab
To Maulvi abu saeed Mohammad Hussain Editor of Ishaat ul sunnah,Lahore
In reply to your letter No 195 of the 12th May last, asking that the use of the expression Wahhabi in reference to the members of the community which you claim to represent may be prohibited in government order.

I am directed to forward the enclosed copy of a letter No 1738 of the 3rd from the officiating Secretary to the government of India in the Home Department,sanctioning discontinuance of the use of the term Wahabi in official correspondence.

I return the books received with your letter No 547 of the 21 September last, together with the original signed notices which you have been good enough to submit in your subsequent letters for the persual of the government.
ইউ.এম ইয়াং পাঞ্জাব সরকারের সেক্রেটারি-এর পক্ষ থেকে
মৌলভী আবু সাঈদ মোহাম্মাদ হুসাইন ইসহাত উল সুন্নাহ, লাহোর এর সম্পাদক বরাবর,
আপনার চিঠি নাম্বার ১৯৫, ১২ ই মে এর জবাবে,তাতে আপনি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের সদস্যের জন্য ওয়াহাবী শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন যার প্রতিনিধিত্ব আপনি করেন, সরকারী চিঠিপত্রে এটির ব্যবহার নিষিদ্ধ হতে পারে । জনাব লেফটেনেন্ট গভর্নমেন্ট-এর বিধিমত আপনার কাছে চিঠি নাম্বার ১৭৩৮ মোহরকৃত ৩য়-এর অনুলিপি পাঠাচ্ছি।যাতে ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি অধ্যাদেশ জারি করেছে যে,সরকারী চিঠিপত্রে ওয়াহাবী শব্দ যেন ব্যবহার না করা হয়।উক্ত চিঠির সাথে সেসব বইও ফেরত পাঠাচ্ছি যা আপনি গত ২১ সেপ্টেম্বর চিঠি নাম্বার ৫৪৭-এর সাথে নিরীক্ষণের জন্য পাঠিয়েছিলেন। এবং অরজিনাল সাক্ষরিত নোটিশও পাঠানো হল যেটি সরকারের দৃষ্টি অর্জনের জন্য পরবর্তি চিঠির সাথে আপনাকে জমা দিতে হয়েছে।
এই সব ইংরেজি চিঠি মুসলিম আহলে হাদীস গেজেট দিল্লী, ডিসেম্বর ১৯৯৩ থেকে গৃহীত। উক্ত গেজেট এসব ইংরেজি চিঠি ‘আখবারে ইংলিশম্যান কলকাতা, নাম্বার ৪৪, প্রকাশ ২২ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৭, থেকে নকল করে।(তারীখে আহলে হাদীস, সংকলক, ড.বাহাউদ্দীন ১/১২৪-১২৫)

ইংরেজ সরকারের উপরের প্রতিউত্তর চিঠি পাঠকগণ দেখলেন।তারা আহলে হাদীস নামকরণ করে- এ দাবী তো বহুত দূরের কথা।তারা উভয় চিঠিতে একবারের জন্য ‘আহলে হাদীস’ শব্দটি উল্লেখ করেনি।তারা শুধুমাত্র বলেছে আগামীতে আমরা আমাদের সরকারী চিঠিপত্রে ওয়াহাবী লিখবো না।আর ইতিপূর্বে আল্লামাহ হুসাইন আহমাদ বাটালাভী রহিমাহুল্লাহর চিঠি ও স্যার সৈয়দ আহমাদের বক্তব্য দেখিছি যে,আল্লামাহ হুসাইন আহমাদ বাটালাভী রহিমাহুল্লাহ শুধুমাত্র এমর্মে চিঠি দেন যেন সরকারী চিঠিপত্রে ওয়াহাবী না লিখা হয়।তিনি আবেদন করেননি যে,আমাদের আহলে হাদীস নামকরণ করা হোক। আহলে হাদীসকে ওয়াহাবী বলা ছিল সুস্পষ্ট অন্যায় ও বেইনসাফী।এর বিরুদ্ধে আল্লামাহ হুসাইন আহমাদ বাটালাভী রহিমাহুল্লাহ আওয়াজ বুলন্দ করেন।তারই প্রেক্ষিতে তিনি সরকারকে চিঠি দেন যেন ওয়াহাবী বাদ দিয়ে আসল নাম আহলে হাদীস সরকারী চিঠিপত্রে লেখা হয়।চিঠিতে ছিলনা যে,আমরা ওয়াহাবী আর ওয়াহাবী নাম আমাদের ভালো লাগেনা। তাই আমাদের নতুন নাম দেয়া হোক বা আহলে হাদীস নাম দেয়া হোক।তারপরও যদি মেনে নেওয়া হয় যে, আল্লামাহ হুসাইন আহমাদ বাটালাভী আহলে হাদীস নামকরণের জন্য চিঠি দিয়েছিলেন, তবুও প্রমাণ হয়না যে,ইংরেজরা আহলে হাদীস নামকরণ করে।কেননা তারা আহলে হাদীস শব্দটি একটি বারের জন্যও উল্লেখ করেনি।এবার পাঠকগণের হাতে ছেড়ে দিলাম,আপনারা বলুন! ইংরেজরা কি আহলে হাদীস নামকরণ করেছে?

আরো কথা হচ্ছে, এই চিঠি দেওয়ার বহু পূর্ব থেকেই ভারতবর্ষে আহলে হাদীস নাম ব্যবহার হয়ে আসছিল।যারা এই নামে অবহিত হতেন তারা ইংরেজ সরকারকে চিঠি দেয় তাদের মূল নাম ব্যবহার করার জন্য।কেননা ওয়াহাবী তাদের আসল নাম নয়।তাই তারা এই নতুন নাম নিজেদের জন্য মেনে নিতে পারেননি। তারা ফিরিয়ে পেতে চেয়েছিলেন তাদের মূল সম্পত্তি তথা আহলে হাদীস নাম।
উক্ত চিঠি ১৮৮৬ সালে দেয়া হয়।যিনি (আল্লামাহ বাটালাভী) উক্ত চিঠি দেন স্বয়ং তিনি এর পূর্ব থেকে নিজেদের আহলে হাদীস বলতেন এবং এই নাম পছন্দ করতেন।উক্ত চিঠির পূর্বেই তিনি তার ‘ইশা’আতে সুন্নাহ’ পত্রিকায় নিজের এবং নিজেদের দলের জন্য আহলে হাদীস নাম ব্যবহার করতেন। আমরা ১৮৮৬ সালের পূর্বে তার ‘ইশা’আতে সুন্নাহ’ পত্রিকা থেকে আহলে হাদীস নাম ব্যবহারের প্রমাণ পেশ করব।স্বয়ং আল্লামাহ বাটালাভী রহিমাহুল্লাহ লিখেছেন-
মাওলানা সাইয়িদ নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিস মুলকে হিন্দুস্থানে এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি ইলমে হাদীস, ছাত্র ও অনুসারীদের সংখ্যাধিক্যতা এবং জনসাধারণের মাঝে মান্যবরতার দিক থেকে অদ্বিতীয়। সম্মানিত ও মর্যাদাবান ব্যক্তিত্ব এই আহলে হাদীস জামা’আতে আরো রয়েছে। যাদের লেখনীর মাধ্যমে ইলমের প্রচার-প্রসার, প্রবন্ধের মাধ্যমে সুন্নাত প্রতিষ্ঠা এবং বিদ’আদ ও গর্হিত কাজ দূর করার মাধ্যমে দ্বীনের সংস্কার হয়েছে।এই চারটি গুন বিশেষ করে চতুর্থ গুনের ব্যাপারে তার সমতুল্য আমি কাউকে পাইনি।এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা বলতে পারি এবং সরকারকে নিশ্চয়তা দিতে পারি যে,সম্মানিত মাওলানাকে সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন করা মানে আহলে হাদীস জামা’আতের সকলকে সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন করা।আর তাকে অসম্মান করা মানে আহলে হাদীস জামা’আতকে অসম্মান করা। (ইশা’আতে সুন্নাহ, খণ্ড ৬, ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দ)।

আহলে হাদীসের ব্যাপারে কিছু লোক কিছু অপবাদ আরোপ করলে তিনি এক ইশতিহার প্রদান করেন। তা নিম্নরূপ-

এই খাকসার ইশতিহারের মাধ্যমে বর্তমানে প্রচলিত এক হাযার রুপী সে ব্যক্তির জন্য পুরস্কার দেওয়ার অঙ্গীকার করছি, যে আহলে হাদীসের উপর আরোপিত অভিযোগ ও অপবাদ তাদের মামুলী ও গ্রহণযোগ্য কিতাব থেকে (পূর্ব, পশ্চিম, আগের ও পরের লোকদের নিকট গ্রহণযোগ্য) প্রমাণ করবে।অথবা সে যে আহলে হাদীসের অনুসারী তা এমন উসূল ও কানূন থেকে প্রমাণ করবে যার ব্যাপারে অবহিত করেছেন হজরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ,মীযানে শা’রানী বা ইকাফে মুল্লা হায়াত সিন্ধী। অথবা ইশা’আতে সুন্নাহ সংখ্যা নাম্বার ৬, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ১৮৪ তে বর্ণীত হয়েছে, তা প্রমাণ করবে।

ইশতিহার দাতা: আবূ সাঈদ মুহাম্মাদ হুসাইন লাহোরী।(ইশা’আতে সুন্নাহ, সংখ্যা নাম্বার ৫,খণ্ড ৬,মে ১৮৮৩)

পাঠকগণ লক্ষ্য করলেন তিনি ১৮৮৩ সালে আহলে হাদীস নাম ব্যবহার করেছেন।আর তিনি ইংরেজদের চিঠি দেন ১৮৮৬ সালে।তার মানে চিঠি দেওয়ার ৩ বছর পূর্ব থেকেই তিনি আহলে হাদীস নাম ব্যবহার করে আসতেন।তাহলে এই আহলে হাদীস নাম কীভাবে ইংরেজদের দেয়া নাম হতে পারে?

আল্লামাহ হুসাইন আহমাদ বাটালাভী রহিমাহুল্লাহর চিঠি দেওয়ার কারণ:

আল্লামাহ হুসাইন আহমাদ বাটালাভী রহিমাহুল্লাহ বেশ কিছু কারণকে সামনে রেখে উক্ত চিঠি প্রদান করেছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে:

১) তৎকালীন সময়ে ইংরেজ সরকার, বিদ’আত পন্থীসহ আহলে হাদীসের দুশমনরা আহলে হাদীসকে সমাজের চোখে কলুষিত করার জন্য ওয়াহাবী শব্দের ব্যবহার শুরু করে।যার সবচে’ বড় প্রমাণ হচ্ছে তৎকালীন সময়ে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে ডাব্লিউ ডাব্লিউ হান্টার কর্তৃক লিখিত ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ কিতাব।আর ওয়াহাবী শব্দ সে সময়ে গালি, বিদ্রোহী ও বিশ্বাসঘাতক অর্থে ব্যবহার হত।তাই তিনি মেনে নিতেন পারেননি এরুপ ঘৃণিত শব্দ আহলে হাদীসের ব্যাপারে ব্যবহার হোক।যেহেতু ইংরেজ সরকার ওয়াহাবী শব্দের প্রচলন বেশি ঘটায়, তাই তিনি তাদের কাছে এ শব্দ বন্ধের জন্য চিঠি দেন।স্বয়ং আল্লামাহ হুসাইন আহমাদ বাটালাভী রহিমাহুল্লাহ একথা চিঠিতে উল্লেখ করে বলেন: ওয়াহাবী শব্দ যা সাধারণত বিদ্রোহী এবং নিমক হারামের অর্থে ব্যবহার হয় এবং যে শব্দের ব্যবহার হিন্দুস্থানের মুসলমানদের ঐ দলটির ব্যাপারে ব্যবহার হয় যাদেরকে আহলে হাদীস বলা হয়।(‘তাকলীদের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা’ মূল লেখক, প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মাসউদ আহমাদ, ভাষান্তর, মাওলানা হারুন ইযহার, প্রকাশক, মুহাম্মদ আবু তৈয়ব চৌধুরী, প্রকাশকাল, ১৫ এপ্রিল ২০১১, পৃষ্ঠা ৬৪)
২) ওয়াহাবী শব্দের ব্যবহার সে সময়ে ব্যাপকহারে শুরু হয়।এমনকি মূল নাম আহলে হাদীস হারিয়ে যেতে বসেছিল।তিনি ভাবলেন যদি এই অবস্থা চলতে থাকে তবে আহলে হাদীস নামের হয়তো একদিন অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।এর পিছনে যেহেতু ওয়াহাবী শব্দের প্রচলন বেশি দায়ী ছিল, তাই তিনি ওয়াহাবী শব্দের ব্যবহার বন্ধ করতে চান।
৩) সবচে’ বড় কারণ হল তিনি এর মাধ্যমে আহলে হাদীস জনগণকে ইংরেজদের নির্যাতন, জেল,মামলা, হত্যা ইত্যাদির মত ভয়ানক অবস্থা থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। কেননা ওয়াহাবী শব্দ আহলে হাদীসদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হত।আর ওয়াহাবী মানেই ইংরেজ বিরোধী। অতএব তাদের বিরুদ্ধে মামলা-হামলা কর,তাদেরকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলাও,কালাপানিতে নির্বাসন দাও ইত্যাদি। এর সত্যতা আমরা অনেক ইতিহাসবিদদের কিতাবাদি থেকে পাই।যা উল্লেখ করার স্থান এটা নয়।প্রয়োজনে অন্য কোনো দিন উল্লেখ করা যাবে।এর প্রমাণসরূপ বলতে পারি ১৮৬৫ সালে ইংরেজরা অন্যায়ভাবে আহলে হাদীসের বিরুদ্ধে পাঁচ পাঁচটি মামলা দায়ের করে।এবং এই মামলার কারণে অনেক আহলে হাদীস পরিবার সর্বশান্ত হয় এবং বিভিন্ন প্রকার পাশবিক নির্যাতনের সম্মুখীন হয়।এই তৃতীয় কারণ সম্পর্কে স্বয়ং আল্লামাহ হুসাইন আহমাদ বাটালাভী রহিমাহুল্লাহ এভাবে বলেছেন:একজনের কর্মকাণ্ডের কারণে দলের সকলকে খারাপ ভাবা বিবেক ও ইনসাফেপূর্ণ কথা নয়।
উক্ত দ্বিতীয় কারণকে ইনসাফের দৃষ্টিতে দেখলে প্রমাণিত হয় যে,সীমান্ত এলাকায় বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্রকে যারা আহলে হাদীসের কাধে চাপাচ্ছে তারাও ভালভাবে জানে যে, সেসব বিদ্রোহী ও ষড়যন্ত্রকারীদের কারণে গোটা আহলে হাদীসকে খারাপ বলে চিহ্নিত করা ইনসাফ বিরোধী।(ইশা’আতে সুন্নাহ, খণ্ড ৮,১৮৮৬; তারীখে আহলে হাদীস, পৃষ্ঠা ১/১১৬) এর আগে তিনি ব্রিটিনে বিদ্রোহমূলক ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা তুলে ধরে বলেন: এসব লোকদের বিদ্রোহের কারণে কেউ তো গোটা খ্রিষ্টান জাতিকে বিদ্রোহী বলে চিহ্নিত করেনা।

উৎস: https://www.facebook.com/abdullah.mahmud.58367/posts/544612732551584

কুরআনের আলোকে জাহান্নামের বর্ণনা

আল্লাহ তা‘আলা পাপিষ্ঠ বান্দাদের
জন্য জাহান্নাম প্রস্ত্তত করে
রেখেছেন। যারা অবাধ্য,
অস্বীকারকারী, পাপী তাদেরকে
জাহান্নামের জ্বলন্ত আগুনে পুড়তে হবে।
পক্ষান্তরে আল্লাহ তা‘আলার বিধান
অনুযায়ী তার নির্দেশিত পথে চললে
জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করে
জান্নাতবাসী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন
করা সম্ভব হবে। পবিত্র কুরআন ও
ছহীহ হাদীছে জান্নাত-জাহান্নামের
বিশদ বিবরণ বিধৃত হয়েছে। আলোচ্য
নিবন্ধে জাহান্নামের বিভিন্ন শাস্তি
এবং জাহান্নামীদের খাদ্য, পানীয়
প্রভৃতির বিবরণ পেশ করা হ’ল-
(ক) অত্যুষ্ণ বায়ু ও কৃষ্ণবর্ণের ছায়া :
জাহান্নামের আগুনের তীব্র তাপদাহ ও
উষ্ণতা এত প্রখর ও যন্ত্রণাদায়ক
হবে, যা কল্পনাতীত। সেখানে রয়েছে
আগুন হ’তে প্রস্ত্ততকৃত পোশাক,
বিছানা, ছায়া, ভারী বেড়ি এবং আগুনের
জিঞ্জির, আগুনে উত্তপ্ত ও প্রজবলিত
কোটি কোটি টন ভারী লোহা ও গুর্জ,
আগুনে উত্তপ্ত করা আসনসমূহ প্রভৃতি।
সুতরাং যার সৃষ্টি লেলিহান
অগ্নিশিখা হবে তার অভ্যন্তরস্থ
বায়ুর ধ্বংসলীলা কত ভয়ংকর হ’তে
পারে তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,
ُﺏﺎَﺤْﺻَﺃَﻭ ِﻝﺎَﻤِّﺸﻟﺍ ﺎَﻣ ُﺏﺎَﺤْﺻَﺃ
،ِﻝﺎَﻤِّﺸﻟﺍ ْﻲِﻓ ٍﻡْﻮُﻤَﺳ ،ٍﻢْﻴِﻤَﺣَﻭ ٍّﻞِﻇَﻭ
ْﻦِﻣ ،ٍﻡْﻮُﻤْﺤَﻳ َﻻ ٍﺩِﺭﺎَﺑ َﻻَﻭ .ٍﻢْﻳِﺮَﻛ ‘আর
বাম দিকের দল কত হতভাগ্য, বাম
দিকের দল! তারা থাকবে অত্যুষ্ণ বায়ু ও
উত্তপ্ত পানিতে, কৃষ্ণবর্ণের ধূম্রের
ছায়ায়, যা শীতলও নয় আবার
আরামদায়কও নয়’ (ওয়াক্বি‘আহ
৫৬/৪১-৪৪) । জাহান্নামীরা
জাহান্নামের আযাবে অতিষ্ঠ হয়ে এক
ছায়াকর বৃক্ষের দিকে ছুটে আসবে। যখন
সেখানে পৌঁছবে তখন বুঝতে পারবে যে,
এটা কোন ছায়াদানকারী বৃক্ষ নয়, বরং
এটা জাহান্নামের ঘনকালো ধোঁয়া।
অনুরূপভাবে জাহান্নামের বিদগ্ধকারী
কঠিন লু-হাওয়া দিয়ে কাফেরদের
শাস্তি দেওয়া হবে। যেমন মহান
আল্লাহ বলেন, ﺍْﻮُﻟﺎَﻗ ﺎَّﻧِﺇ ﺎَّﻨُﻛ ُﻞْﺒَﻗ
ْﻲِﻓ ﺎَﻨِﻠْﻫَﺃ ،َﻦْﻴِﻘِﻔْﺸُﻣ َّﻦَﻤَﻓ ُﻪﻠﻟﺍ
ﺎَﻨْﻴَﻠَﻋ ﺎَﻧﺎَﻗَﻭَﻭ َﺏﺍَﺬَﻋ .ِﻡْﻮُﻤَّﺴﻟﺍ
‘তারা বলবে, পূর্বে আমরা
পবিবারবর্গের মধ্যে শংকিত অবস্থায়
ছিলাম। তারপর আমাদের প্রতি
আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন এবং
আমাদেরকে অগ্নিশাস্তি থেকে রক্ষা
করেছেন’ (তূর ৫২/২৬-২৭) ।
জাহান্নামের ছায়ার বর্ণনা দিয়ে
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﺍْﻮُﻘِﻠَﻄْﻧِﺍ ﻰَﻟِﺇ
ﺎَﻣ ْﻢُﺘْﻨُﻛ ِﻪِﺑ ،َﻥْﻮُﺑِّﺬَﻜُﺗ ﺍْﻮُﻘِﻠَﻄْﻧﺍ
ﻰَﻟِﺇ ٍّﻞِﻇ ْﻱِﺫ ِﺙَﻼَﺛ ،ٍﺐَﻌُﺷ َﻻ ٍﻞْﻴِﻠَﻇ َﻻَﻭ
ْﻲِﻨْﻐُﻳ َﻦِﻣ ،ِﺐَﻬَّﻠﻟﺍ ﺎَﻬَّﻧِﺇ ْﻲِﻣْﺮَﺗ
ٍﺭَﺮَﺸِﺑ ،ِﺮْﺼَﻘْﻟﺎَﻛ ُﻪَّﻧَﺄَﻛ ٌﺖَﻟﺎَﻤِﺟ
،ٌﺮْﻔُﺻ ٌﻞْﻳَﻭ ٍﺬِﺌَﻣْﻮَﻳ .َﻦْﻴِﺑِّﺬَﻜُﻤْﻠِﻟ
‘তোমরা যাকে অস্বীকার করতে, চল
তারই দিকে। চল তিন শাখা বিশিষ্ট
ছায়ার দিকে, যে ছায়া শীতল নয় এবং
যে ছায়া অগ্নিশিখা হ’তে রক্ষা করতে
পারে না। তা উৎক্ষেপণ করবে
অট্টালিকাতুল্য বৃহৎ স্ফুলিঙ্গ, তা
পীতবর্ণ উষ্ট্রশ্রেণী সদৃশ। সেই
দিন দুর্ভোগ মিথ্যারোপকারীদের
জন্য’ (মুরসালাত ৭৭/২৯-৩৪) ।
জাহান্নামের অগ্নিবায়ুর উষ্ণতা এত
প্রখর ও কঠিন, যা সকল
জাহান্নামীকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে
দিবে। যে আগুন মানুষকে জীবিত
থাকতেও দিবে না, আবার মরতেও দিবে
না। মহান আল্লাহ বলেন, ﺎَﻣَﻭ َﻙﺍَﺭْﺩَﺃ
ﺎَﻣ ،ُﺮَﻘَﺳ َﻻ ْﻲِﻘْﺒُﺗ َﻻَﻭ ٌﺔَﺣﺍَّﻮَﻟ ،ُﺭَﺬَﺗ
.ِﺮَﺸَﺒْﻠِّﻟ ‘তুমি কি জান সাক্বার কি?
তা (মানুষকে) অক্ষতও রাখবে না, আবার
ছেড়েও দিবে না। মানুষকে দগ্ধ করবে’
(মুদ্দাচ্ছির ৭৪/২৭-২৯) । এ ব্যাপারে
আল্লাহ বলেন, ﺎَّﻠَﻛ َّﻥَﺬَﺒْﻨُﻴَﻟ ﻲِﻓ
،ِﺔَﻤَﻄُﺤْﻟﺍ ﺎَﻣَﻭ َﻙﺍَﺭْﺩَﺃ ﺎَﻣ
،ُﺔَﻤَﻄُﺤْﻟﺍ ُﺭﺎَﻧ ِﻪﻠﻟﺍ ،ُﺓَﺪَﻗﻮُﻤْﻟﺍ
ْﻲِﺘَّﻟﺍ ُﻊِﻠَّﻄَﺗ ،ِﺓَﺪِﺌْﻓَﺄْﻟﺍ ﻰَﻠَﻋ ﺎَﻬَّﻧِﺇ
ْﻢِﻬْﻴَﻠَﻋ ،ٌﺓَﺪَﺻْﺆُّﻣ ْﻲِﻓ ٍﺪَﻤَﻋ .ٍﺓَﺩَّﺪَﻤُﻣ
‘কখনো না। সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে
পিষ্টকারীর মধ্যে। আপনি কি জানেন
পিষ্টকারী কি? এটা আল্লাহ্র
প্রজ্বলিত আগুন, যা হৃদয়ে পৌঁছবে।
এতে তাদের বেঁধে দেওয়া হবে লম্বা লম্বা
খুঁটিতে’ (হুমাযাহ ১০৪/৪-৯) ।
জাহান্নামের আগুন অনবরত প্রজ্বলন
করা হবে। তাপ কমে যাওয়ার সাথে সাথে
আবার জ্বালানো হবে। তা কখনো
নির্বাপিত হবে না। আল্লাহ তা‘আলা
বলেন, ﺎَّﻣَﺃَﻭ ْﻦَﻣ ْﺖَّﻔَﺧ ،ُﻪُﻨْﻳِﺯﺍَﻮَﻣ
ُﻪُّﻣُﺄَﻓ ،ٌﺔَﻳِﻭﺎَﻫ ﺎَﻣَﻭ َﻙﺍَﺭْﺩَﺃ ﺎَﻣ
،ْﻪَﻴِﻫ ٌﺭﺎَﻧ .ٌﺔَﻴِﻣﺎَﺣ ‘আর যার
(নেকীর) পাল্লা হালকা হবে তার স্থান
হবে হাবিয়া। আপনি কি জানেন
হাবিয়া কি? তা হ’ল জ্বলন্ত আগুন’
(ক্বারি‘আহ ১০১/৮-১১) । রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) বলেন, ُﺖْﻳَﺃَﺭ َﺔَﻠْﻴَّﻠﻟﺍ ِﻦْﻴَﻠُﺟَﺭ
…ﻰِﻧﺎَﻴَﺗَﺃ َﻻﺎَﻗ ﻯِﺬَّﻟﺍ ُﺪِﻗْﻮُﻳ
َﺭﺎَّﻨﻟﺍ ٌﻚِﻟﺎَﻣ ُﻥِﺯﺎَﺧ .ِﺭﺎَّﻨﻟﺍ ‘আজ
রাতে আমি স্বপ্ন দেখলাম যে, দু’জন
লোক আমার কাছে এসে বলল,… যিনি
আগুন প্রজ্বলিত করছেন তিনি হ’লেন
জাহান্নামের দারোগা ‘মালেক’।[1]
জাহান্নামের আগুনের জ্বালানী হবে
মানুষ ও পাথর। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
ﺍﻮُﻘَّﺗﺎَﻓ َﺭﺎَّﻨﻟﺍ ْﻲِﺘَّﻟﺍ ﺎَﻫُﺩْﻮُﻗَﻭ
ُﺱﺎَّﻨﻟﺍ ُﺓَﺭﺎَﺠِﺤْﻟﺍَﻭ ْﺕَّﺪِﻋُﺃ
َﻦْﻳِﺮِﻓﺎَﻜْﻠِﻟ‘অতএব সে আগুনকে ভয় কর,
যার জ্বালানী হবে মানুষ ও পাথর, যা
প্রস্ত্তত করা হয়েছে কাফেরদের জন্য’
(বাক্বারাহ ২/২৪) ।
জাহান্নামের আগুনের লু-হাওয়া সহ্য
করা মানুষের জন্য অসম্ভব হবে। যেমন
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
ْﺪَﻘَﻟ َﺀﻰِﺟ ِﺭﺎَّﻨﻟﺎِﺑ ْﻢُﻜِﻟَﺫَﻭ َﻦْﻴِﺣ
ْﻰِﻧﻮُﻤُﺘْﻳَﺃَﺭ ُﺕْﺮَّﺧَﺄَﺗ َﺔَﻓﺎَﺨَﻣ ْﻥَﺃ
ْﻰِﻨَﺒْﻴِﺼُﻳ ْﻦِﻣ …ﺎَﻬِﺤْﻔَﻟ
‘(সূর্য গ্রহণের ছালাতের সময়) আমার
নিকট জাহান্নাম উপস্থিত করা হ’ল,
যখন তোমরা আমাকে পিছনে সরে আসতে
দেখেছিলে। এ ভয়ে যাতে আমার শরীরে
আগুনের উষ্ণতা না লাগে…’।[2]
গ্রীষ্মকালে গরমের তীব্রতা
জাহান্নামের আগুনের উষ্ণ বাষ্পের
কারণেই হয়ে থাকে এবং জ্বরও
জাহান্নামের আগুনের একটি অংশ।
যেমন হাদীছে এসেছে,
ْﻦَﻋ ﻰِﺑَﺃ َﺓَﺮْﻳَﺮُﻫ ِﻦَﻋt ِّﻰِﺒَّﻨﻟﺍ َﻝﺎَﻗr
ﺍَﺫِﺇ َّﺪَﺘْﺷﺍ ُّﺮَﺤْﻟﺍ ﺍْﻭُﺩِﺮْﺑَﺄَﻓ
ِﺓَﻼَّﺼﻟﺎِﺑ َّﻥِﺈَﻓ َﺓَّﺪِﺷ ِّﺮَﺤْﻟﺍ ْﻦِﻣ ِﺢْﻴَﻓ
َﻢَّﻨَﻬَﺟ ِﺖَﻜَﺘْﺷﺍَﻭ ُﺭﺎَّﻨﻟﺍ ﻰَﻟِﺇ ﺎَﻬِّﺑَﺭ
ْﺖَﻟﺎَﻘَﻓ ﺎَﻳ ِّﺏَﺭ َﻞَﻛَﺃ ْﻰِﻀْﻌَﺑ ﺎًﻀْﻌَﺑ
َﻥِﺫَﺄَﻓ ﺎَﻬَﻟ ِﻦْﻴَﺴَﻔَﻨِﺑ ٍﺲَﻔَﻧ ﻰِﻓ
ِﺀﺎَﺘِّﺸﻟﺍ ٍﺲَﻔَﻧَﻭ ﻰِﻓ ِﻒْﻴَّﺼﻟﺍ َﻮُﻬَﻓ
ُّﺪَﺷَﺃ ﺎَﻣ َﻥْﻭُﺪِﺠَﺗ َﻦِﻣ ِّﺮَﺤْﻟﺍ ُّﺪَﺷَﺃَﻭ ﺎَﻣ
َﻥْﻭُﺪِﺠَﺗ َﻦِﻣ .ِﺮْﻳِﺮَﻬْﻣَّﺰﻟﺍ
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী
করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘যখন গরম
বৃদ্ধি পায় তখন ছালাত (বিলম্বে
আদায়ের) মাধ্যমে তা ঠান্ডা কর। কারণ
গরমের তীব্রতা জাহান্নামের
নিঃশ্বাসের কারণে হয়। আর
জাহান্নাম আল্লাহ্র কাছে অভিযোগ
করল যে, হে আমার প্রতিপালক! আমার
এক অংশ অপর অংশকে খেয়ে ফেলছে
(অতএব আমাকে নিঃশ্বাস ত্যাগের
অনুমতি দিন)। অতঃপর আল্লাহ তাকে
বছরে দু’বার নিঃশ্বাস ত্যাগের অনুমতি
দিলেন। একটি শীতকালে আর অপরটি
গ্রীষ্মকালে। তোমরা গ্রীষ্মকালে যে
কঠিন গরম অনুভব কর, তা এ নিঃশ্বাস
ত্যাগের কারণে আর শীতকালে যে কঠিন
শীত অনুভব কর, তাও ঐ নিঃশ্বাস
ত্যাগের কারণে হয়ে থাকে’।[3]
(খ) জাহান্নামের পানীয় :
জাহান্নামের উত্তপ্ত আগুনের
তীব্রতায় তার অধিবাসীদের পিপাসায়
বুক ফেটে যাবার উপক্রম হবে। তৃষ্ণার্ত
পাপীরা পানির জন্য হাহাকার করবে।
বুকফাটা আর্তনাদ করবে একফোঁটা
পানির জন্য। সেদিন তাদের
গগণবিদারী চিৎকার শুনার কেউ
থাকবে না। এমন কঠিন মুহূর্তে
তাদেরকে দেওয়া হবে রক্ত, পূঁজ
মিশ্রিত, দুর্গন্ধযুক্ত উত্তপ্ত
পানি। প্রচন্ড পিপাসায় তারা উক্ত
পানীয় পান করবে। কিন্তু তা তাদের
তৃষ্ণা মেটাবে না। বরং আযাবের আরেক
অধ্যায়ের সূচনা হবে। পবিত্র কুরআন ও
ছহীহ হাদীছে জাহান্নামীদের প্রদত্ত
পাঁচ প্রকার পানীয়ের বিবরণ পাওয়া
যায়।[4] পানীয়গুলো সম্পর্কে
সংক্ষেপে আলোচনা করা হ’ল।
১. ٌﻢْﻴِﻤَﺣ ٌﺀﺎَﻣ (উত্তপ্ত পানি) :
কাফেরদেরকে জাহান্নামে ফুটন্ত পানীয়
পান করতে দেওয়া হবে। এতে তার নাড়ি-
ভুঁড়ি ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাবে।
তাদেরকে যখন খাদ্য হিসাবে যাক্কূম
গাছের তিক্ত কাঁটাযুক্ত ফল দেওয়া হবে,
তখন তা গলায় বিঁধে গেলে তারা পানি
চাইবে। তখন তাদেরকে গরম পানি দেয়া
হবে এবং তারা তা তৃষ্ণার্ত উটের ন্যায়
পান করতে থাকবে। যেমন আল্লাহ
তা‘আলার বাণী, َّﻢُﺛ ْﻢُﻜَّﻧِﺇ ﺎَﻬُّﻳَﺃ
َﻥْﻮُّﻟﺎَّﻀﻟﺍ ،َﻥْﻮُﺑِّﺬَﻜُﻤْﻟﺍ َﻥْﻮُﻠِﻛﺂَﻟ
ْﻦِﻣ ٍﺮَﺠَﺷ ْﻦِّﻣ ،ٍﻡْﻮُّﻗَﺯ َﻥْﻮُﺌِﻟﺎَﻤَﻓ
ﺎَﻬْﻨِﻣ ،َﻥْﻮُﻄُﺒْﻟﺍ َﻥْﻮُﺑِﺭﺎَﺸَﻓ ِﻪْﻴَﻠَﻋ
َﻦِﻣ ،ِﻢْﻴِﻤَﺤْﻟﺍ َﻥْﻮُﺑِﺭﺎَﺸَﻓ َﺏْﺮُﺷ
،ِﻢْﻴِﻬْﻟﺍ ﺍَﺬَﻫ ْﻢُﻬُﻟُﺰُﻧ َﻡْﻮَﻳ .ِﻦْﻳِّﺪﻟﺍ
‘অতঃপর হে বিভ্রান্ত মিথ্যাবাদীরা!
তোমরা অবশ্যই যাক্কূম বৃক্ষ হ’তে
আহার করবে এবং তা দিয়ে তোমাদের
পেট পূর্ণ করবে। তারপর তোমরা পান
করবে টগবগে ফুটন্ত পানি। তা পান
করবে তৃষ্ণার্ত উষ্ট্রের ন্যায়।
ক্বিয়ামতের দিন এটাই হবে তাদের
আপ্যায়ন’ (ওয়াক্বি‘আহ ৫৬/৫১-৫৬) ।
এ মর্মে তিনি আরো বলেন, ْﻢُﻬَّﻧِﺈَﻓ
َﻥْﻮُﻠِﻛﺂَﻟ ﺎَﻬْﻨِﻣ َﻥْﻮُﺌِﻟﺎَﻤَﻓ ﺎَﻬْﻨِﻣ
،َﻥْﻮُﻄُﺒْﻟﺍ َّﻢُﺛ َّﻥِﺇ ْﻢُﻬَﻟ ﺎَﻬْﻴَﻠَﻋ
ﺎًﺑْﻮَﺸَﻟ ْﻦِّﻣ .ٍﻢْﻴِﻤَﺣ ‘তা থেকে তারা
অবশ্যই আহার করবে এবং তাদের পেট
পূর্ণ করবে। অতঃপর তাদের জন্য
থাকবে ফুটন্ত পানির মিশ্রণ’
(ছাফফাত ৩৭/৬৬-৬৭) । জাহান্নাম
অস্বীকারকারীদের শাস্তির বিবরণ
দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ِﻩِﺬَﻫ
ُﻢَّﻨَﻬَﺟ ْﻲِﺘَّﻟﺍ ُﺏِّﺬَﻜُﻳ ﺎَﻬِﺑ
،َﻥْﻮُﻣِﺮْﺠُﻤْﻟﺍ َﻥْﻮُﻓْﻮُﻄَﻳ ﺎَﻬَﻨْﻴَﺑ
َﻦْﻴَﺑَﻭ ٍﻢْﻴِﻤَﺣ .ٍﻥﺁ ‘এটা সেই
জাহান্নাম, যাকে অপরাধীরা মিথ্যা
প্রতিপন্ন করত। তারা জাহান্নামের
অগ্নি ও ফুটন্ত পানির মধ্যে ছুটাছুটি
করবে’ (আর-রহমান ৫৫/৪৩-৪৪) ।
পৃথিবীর মানুষদের নিকটে আল্লাহ
তা‘আলা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেন,ْﻦَﻤَﻛ
َﻮُﻫ ٌﺪِﻟﺎَﺧ ﻲِﻓ ِﺭﺎَّﻨﻟﺍ ﺍْﻮُﻘُﺳَﻭ ًﺀﺎَﻣ
ﺎًﻤْﻴِﻤَﺣ َﻊَّﻄَﻘَﻓ ْﻢُﻫَﺀﺎَﻌْﻣَﺃ
‘(মুত্তাক্বীরা কি তাদের মত) যারা
জাহান্নামের স্থায়ী বাসিন্দা হবে এবং
যাদের পান করতে দেওয়া হবে উত্তপ্ত
পানি, যা তাদের নাড়ি-ভুঁড়ি ছিন্ন-
ভিন্ন করে ফেলবে?’ (মুহাম্মাদ
৪৭/১৫) ।
২. ٌﻕﺎَّﺴَﻏ ٌﺀﺎَﻣ (দুর্গন্ধযুক্ত পানি) :
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন, এটি
জাহান্নামীদের গলিত রস বিশেষ।[5]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘সুতরাং তারা
আস্বাদন করুক ফুটন্ত পানি ও পুঁজ’
(ছোয়াদ ৩৮/৫৫-৫৮) ।
৩. ٌﻦْﻴِﻠْﺴِﻏَﻭ ٌﺀﺎَﻣ ٌﺪْﻳِﺪَﺻ (ক্ষতস্থান
হ’তে নির্গত পুঁজ ও রক্ত):
জাহান্নামীদের শরীরের পঁচা
দুর্গন্ধযুক্ত মাংসকে বা ফোঁড়া থেকে
নির্গত পুঁজ ও দুর্গন্ধযুক্ত পানিকে
ﻦْﻴِﻠْﺴِﻏবলা হয়।[6] আর ﺪﻳِﺪَﺻবলা
হয় ফোঁড়া বা ক্ষতস্থান থেকে নির্গত
দুর্গন্ধযুক্ত দূষিত রস বা পুঁজকে।[7]
উপরোক্ত দুর্গন্ধযুক্ত অপবিত্র পানি,
পুঁজ হবে জাহান্নামীদের পানীয়। যা
তারা অতি কষ্টে গলাধঃকরণ করবে।
মহান আল্লাহ বলেন, ْﻦِﻣ ِﻪِﺋﺍَﺭَّﻭ
ُﻢَّﻨَﻬَﺟ ﻰَﻘْﺴُﻳَﻭ ْﻦِﻣ ٍﺀﺎَﻣ ،ٍﺪْﻳِﺪَﺻ
ُﻪُﻋَّﺮَﺠَﺘَﻳ َﻻَﻭ ُﺩﺎَﻜَﻳ ُﻪُﻐْﻴِﺴُﻳ ِﻪْﻴِﺗْﺄَﻳَﻭ
ُﺕْﻮَﻤْﻟﺍ ْﻦِﻣ ِّﻞُﻛ ٍﻥﺎَﻜَﻣ ﺎَﻣَﻭ َﻮُﻫ ٍﺖِّﻴَﻤِﺑ
ْﻦِﻣَﻭ ِﻪِﺋﺍَﺭَّﻭ ٌﺏﺍَﺬَﻋ .ٌﻆْﻴِﻠَﻏ ‘তাদের
প্রত্যেকের পরিণাম জাহান্নাম এবং
সকলকে পান করানো হবে অপবিত্র
দুর্গন্ধযুক্ত গলিত পুঁজ। যা সে অতি
কষ্টে গলাধঃকরণ করবে, আর তা তার
জন্য অসম্ভব হয়ে পড়বে। তার নিকটে
মৃত্যুযন্ত্রণা আসবে চতুর্দিক থেকে।
কিন্তু তার মৃত্যু হবে না এবং এরপর সে
কঠোর শাস্তি ভোগ করতে থাকবে’
(ইবরাহীম ১৪/১৬-১৭) । অন্যত্র
তিনি বলেন, َﺲْﻴَﻠَﻓ ُﻪَﻟ َﻡْﻮَﻴْﻟﺍ
ﺎَﻨُﻫﺎَﻫ ،ٌﻢْﻴِﻤَﺣ َﻻَﻭ ٌﻡﺎَﻌَﻃ َّﻻِﺇ ْﻦِﻣ
،ٍﻦْﻴِﻠْﺴِﻏ َﻻ ُﻪُﻠُﻛْﺄَﻳ َّﻻِﺇ .َﻥْﻮُﺌِﻃﺎَﺨْﻟﺍ
‘অতএব সেখানে সেদিন তার কোন
অন্তরঙ্গ বন্ধু থাকবে না এবং কোন
খাদ্য থাকবে না রক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত
পুঁজ ব্যতীত। যা শুধুমাত্র অপরাধীরাই
ভক্ষণ করবে’ (হা-ক্কাহ ৬৯/৩৫-৩৭) ।
৪. ِﻞْﻬُﻤْﻟﺍ ُﺀﺎَﻣ (তৈলাক্ত গরম
পানি) :
উত্তপ্ত তৈলাক্ত পানীয়কে ِﻞْﻬُﻤْﻟﺍ
ُﺀﺎَﻣবলে। ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন,
ُﻞْﻬُﻤْﻟﺍহ’ল উত্তপ্ত তেলের সর্বশেষ
অংশ।[8] ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন,
কদর্যপূর্ণ গরম তৈলাক্ত পানীয়কে
ُﻞْﻬُﻤْﻟﺍবলা হয়।[9] যাহহাক (রহঃ)
বলেন, অতি গাঢ় কৃষ্ণ পানীয়কে
ُﻞْﻬُﻤْﻟﺍবলে।[10] এটা জাহান্নামীদের
পানীয় হিসাবে প্রদান করা হবে।
মহান আল্লাহ বলেন, ْﻥِﺇَﻭ ﺍْﻮُﺜْﻴِﻐَﺘْﺴَﻳ
ﺍْﻮُﺛﺎَﻐُﻳ ٍﺀﺎَﻤِﺑ ِﻞْﻬُﻤْﻟﺎَﻛ ﻱِﻮْﺸَﻳ
َﻩْﻮُﺟُﻮْﻟﺍ َﺲْﺌِﺑ ُﺏﺍَﺮَّﺸﻟﺍ ْﺕَﺀﺎَﺳَﻭ
.ﺎًﻘَﻔَﺗْﺮُﻣ ‘তারা পানি চাইলে তাদেরকে
বিগলিত গরম তৈলাক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত
পানীয় প্রদান করা হবে। যা তাদের
মুখমন্ডল বিদগ্ধ করবে। এটা নিকৃষ্ট
পানীয় আর জাহান্নাম কতই না নিকৃষ্ট
আবাসস্থল’! (কাহাফ ১৮/২৯) । অন্যত্র
মহান আল্লাহ বলেন, َّﻥﺇ َﺕَﺮَﺠَﺷ
،ِﻡْﻮُّﻗَّﺰﻟﺍ ُﻡﺎَﻌَﻃ ،ِﻢْﻴِﺛَﺄْﻟﺍ
ِﻞْﻬُﻤْﻟﺎَﻛ ْﻲِﻠْﻐَﻳ ﻲِﻓ ،ِﻥْﻮُﻄُﺒْﻟﺍ ِﻲْﻠَﻐَﻛ
.ِﻢْﻴِﻤَﺤْﻟﺍ ‘নিশ্চয়ই যাক্কূম বৃক্ষ হবে
পাপীদের খাদ্য, যা গলিত তাম্রের মত,
তা তার পেটে ফুটতে থাকবে ফুটন্ত
পানির মত’ (দুখান ৪৪/৪৩-৪৬) ।
৫. ُﺔَﻨْﻴِﻃ ِﻝﺎَﺒَﺨْﻟﺍ (শরীর থেকে
নির্গত ঘাম) :
জাহান্নামীদের শরীর থেকে নির্গত
ঘাম অথবা শরীরের ফোঁড়া থেকে
নির্গত দুর্গন্ধযুক্ত পুঁজকে ُﺔَﻨْﻴِﻃ
ِﻝﺎَﺒَﺨْﻟﺍবলা হয়।[11] পৃথিবীতে
যারা মদ কিংবা নেশা জাতীয় দ্রব্য
পান করত এবং যারা অহংকারে স্ফীত
হয়ে দুনিয়ায় চলাচল করত, তাদেরকে
জাহান্নামে শরীর থেকে নির্গত
দুর্গন্ধযুক্ত ঘাম বা বিষাক্ত পুঁজ পান
করতে দেওয়া হবে। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) বলেছেন,
ُّﻞُﻛ ٍﺮِﻜْﺴُﻣ ٌﻡﺍَﺮَﺣ َّﻥِﺇ ﻰَﻠَﻋ ِﻪﻠﻟﺍ َّﺰَﻋ
َّﻞَﺟَﻭ ﺍًﺪْﻬَﻋ ْﻦَﻤِﻟ ُﺏَﺮْﺸَﻳ َﺮِﻜْﺴُﻤْﻟﺍ ْﻥَﺃ
ُﻪَﻴِﻘْﺴَﻳ ْﻦِﻣ ِﺔَﻨْﻴِﻃ ِﻝﺎَﺒَﺨْﻟﺍ ﺍْﻮُﻟﺎَﻗ
ﺎَﻳ َﻝْﻮُﺳَﺭ ِﻪﻠﻟﺍ ﺎَﻣَﻭ ُﺔَﻨْﻴِﻃ
ِﻝﺎَﺒَﺨْﻟﺍ َﻝﺎَﻗ ُﻕَﺮَﻋ ِﻞْﻫَﺃ ِﺭﺎَّﻨﻟﺍ ْﻭَﺃ
ُﺓَﺭﺎَﺼُﻋ ِﻞْﻫَﺃ .ِﺭﺎَّﻨﻟﺍ
‘প্রত্যেক নেশা সৃষ্টিকারী বস্ত্তই
হারাম। আর আল্লাহ তা‘আলা অঙ্গীকার
করেছেন, যে ব্যক্তি নেশাযুক্ত পানীয়
পান করবে জাহান্নামে তাকে ‘ত্বীনাতুল
খাবাল’ পান করানো হবে। ছাহাবীগণ
জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহ্র রাসূল
(ছাঃ)! ‘ত্বীনাতুল খাবাল’ কি? তিনি
বললেন, তা হ’ল জাহান্নামীদের ঘাম বা
পুঁজ’।[12] অন্য হাদীছে এসেছে আমর
ইবনু শু‘আয়ব তাঁর পিতা থেকে তিনি
তাঁর দাদা থেকে বর্ণনা করেন, নবী
করীম (ছাঃ) বলেছেন,
ُﺮَﺸْﺤُﻳ َﻥْﻭُﺮِّﺒَﻜَﺘُﻤْﻟﺍ َﻡْﻮَﻳ ِﺔَﻣﺎَﻴِﻘْﻟﺍ
َﻝﺎَﺜْﻣَﺃ ِّﺭَّﺬﻟﺍ ْﻰِﻓ ِﺭَﻮُﺻ ِﻝﺎَﺟِّﺮﻟﺍ
ُﻢُﻫﺎَﺸْﻐَﻳ ُّﻝُّﺬﻟﺍ ْﻦِﻣ ِّﻞُﻛ ٍﻥﺎَﻜَﻣ
َﻥْﻮُﻗﺎَﺴُﻴَﻓ ﻰَﻟِﺇ ٍﻦْﺠِﺳ ْﻰِﻓ َﻢَّﻨَﻬَﺟ
ﻰَّﻤَﺴُﻳ َﺲَﻟْﻮُﺑ ْﻢُﻫْﻮُﻠْﻌَﺗ ُﺭﺎَﻧ ِﺭﺎَﻴْﻧَﻷﺍ
َﻥْﻮَﻘْﺴُﻳ ْﻦِﻣ ِﺓَﺭﺎَﺼُﻋ ِﻞْﻫَﺃ ِﺭﺎَّﻨﻟﺍ
ِﺔَﻨْﻴِﻃ .ِﻝﺎَﺒَﺨْﻟﺍ
‘ক্বিয়ামতের দিন অহংকারীরা
মানুষরূপী ছোট্ট পিপীলিকা সদৃশ
হবে। লাঞ্ছনা ও অপমান তাদেরকে
চতুর্দিক থেকে পরিবেষ্টন করে
রাখবে। জাহান্নামের ‘বুলস’ নামক
কারাগারে তাদেরকে তাড়া করে নিয়ে
যাওয়া হবে। জাহান্নামে তাদের জন্য
লেলিহান অগ্নি প্রজ্বলিত করা হবে
এবং সেখানে তাদের ‘ত্বীনাতুল খাবাল’
অর্থাৎ শরীর থেকে নির্গত বিষাক্ত
ঘাম বা দুর্গন্ধযুক্ত পুঁজ জাতীয়
পানীয় পান করতে দেওয়া হবে’।[13]
উল্লেখ্য যে, পৃথিবীতে যারা
তথাকথিত অভিজাত ছিল, যারা
আল্লাহ্র নিদর্শনাবলীর প্রতি
সন্দেহ পোষণ করত এবং যারা তাদের
প্রতিপালক আল্লাহ সম্পর্কে বিভিন্ন
কূট-কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করত ও
অযথা তর্ক-বিতর্ক করত, ক্বিয়ামতের
দিন তাদেরকে জাহান্নামের মাঝখানে
নিয়ে মাথার উপর ফুটন্ত উত্তপ্ত
পানি বর্ষণ করা হবে। এতে তাদের
চর্বি, চামড়া, নাড়ি-ভুঁড়ি, কলিজা সহ
সব কিছুই জ্বলে যাবে। অতঃপর তা
পশ্চাৎদেশ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে
পড়বে। তারপর পুনরায় পূর্বের অবস্থায়
ফিরে যাবে। এভাবেই চলতে থাকবে
শাস্তি। আল্লাহ বলেন, ُﻩْﻭُﺬُﺧ
ُﻩْﻮُﻠِﺘْﻋﺎَﻓ ﻰَﻟِﺇ ِﺀﺍَﻮَﺳ ،ِﻢْﻴِﺤَﺠْﻟﺍ َّﻢُﺛ
ﺍْﻮُّﺒُﺻ َﻕْﻮَﻓ ِﻪِﺳْﺃَﺭ ْﻦِﻣ ِﺏﺍَﺬَﻋ
،ِﻢْﻴِﻤَﺤْﻟﺍ ْﻕُﺫ َﻚَّﻧِﺇ َﺖْﻧَﺃ ُﺰْﻳِﺰَﻌْﻟﺍ
،ُﻢْﻳِﺮَﻜْﻟﺍ َّﻥِﺇ ﺍَﺬَﻫ ﺎَﻣ ْﻢُﺘْﻨُﻛ ِﻪِﺑ
.َﻥْﻭُﺮَﺘْﻤَﺗ ‘তাকে ধর এবং টেনে-হেচড়ে
জাহান্নামের মাঝখানে নিয়ে যাও।
অতঃপর তার মাথার উপর ফুটন্ত
উত্তপ্ত পানি ঢেলে শাস্তি দাও এবং
(বলা হবে) স্বাদ গ্রহণ কর, তুমিতো
ছিলে মর্যাদাবান অভিজাত। এটা তো
সেটাই যে বিষয়ে তোমরা সন্দেহ
পোষণ করতে’ (দুখান ৪৪/৪৭-৫০) ।
অন্য আয়াতে তিনি বলেন, ِﻥﺍَﺬَﻫ
ِﻥﺎَﻤْﺼَﺧ ﺍْﻮُﻤَﺼَﺘْﺧﺍ ْﻲِﻓ ْﻢِﻬِّﺑَﺭ
َﻦْﻳِﺬَّﻟﺎَﻓ ﺍْﻭُﺮَﻔَﻛ ْﺖَﻌِّﻄُﻗ ْﻢُﻬَﻟ ٌﺏﺎَﻴِﺛ
ْﻦِﻣ ٍﺭﺎَﻧ ُّﺐَﺼُﻳ ْﻦِﻣ ِﻕْﻮَﻓ ُﻢِﻬِﺳْﻭُﺀُﺭ
،ُﻢْﻴِﻤَﺤْﻟﺍ ُﺮَﻬْﺼُﻳ ِﻪِﺑ ﺎَﻣ ْﻲِﻓ
ْﻢِﻬِﻧْﻮُﻄُﺑ ،ُﺩْﻮُﻠُﺠْﻟﺍَﻭ ْﻢُﻬَﻟَﻭ ُﻊِﻣﺎَﻘَﻣ
ْﻦِﻣ ،ٍﺪْﻳِﺪَﺣ ﺎَﻤَّﻠُﻛ ﺍْﻭُﺩﺍَﺭَﺃ ْﻥَﺃ
ﺍْﻮُﺟُﺮْﺨَﻳ ﺎَﻬْﻨِﻣ ْﻦِﻣ ٍّﻢَﻏ ﺍْﻭُﺪْﻴِﻋُﺃ
ﺎَﻬْﻴِﻓ ﺍْﻮُﻗْﻭُﺫَﻭ َﺏﺍَﺬَﻋ .ِﻖْﻳِﺮَﺤْﻟﺍ
‘এরা দু’টি বিবদমান পক্ষ। তারা
তাদের প্রতিপালক সম্পর্কে তর্ক-
বিতর্ক করে। আর যারা কুফরী করে
তাদের জন্য প্রস্ত্তত করে রাখা হয়েছে
আগুনের পোশাক; তাদের মাথার উপর
ঢেলে দেওয়া হবে ফুটন্ত পানি। যা
দ্বারা তাদের পেটে যা আছে তা এবং
তাদের চামড়া বিগলিত করা হবে। আর
তাদের জন্য লৌহ নির্মিত হাতুড়ী
সমূহ থাকবে। যখনই তারা তাতে
যন্ত্রণায় কাতর হয়ে সেখান থেকে বের
হ’তে চাইবে, তখনই আবার ফিরিয়ে
দেওয়া হবে এবং (বলা হবে)
যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি আস্বাদন কর’
(হজ্জ ২২/১৯-২২) । এ মর্মে
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
َّﻥِﺇ َﻢْﻴِﻤَﺤْﻟﺍ ُّﺐَﺼُﻴَﻟ ﻰَﻠَﻋ ْﻢِﻬِﺳْﻭُﺀُﺭ
ُﺬُﻔْﻨَﻴَﻓ َﺔَﻤُﺠْﻤُﺠْﻟﺍ ﻰَّﺘَﺣ َﺺُﻠْﺨَﻳ ﻰَﻟِﺇ
ِﻪِﻓْﻮَﺟ َﺖُﻠْﺴَﻴَﻓ ﺎَﻣ ْﻰِﻓ ِﻪِﻓْﻮَﺟ ﻰَّﺘَﺣ
َﻕُﺮْﻤَﻳ ْﻦِﻣ ِﻪْﻴَﻣَﺪَﻗ َﻮُﻫَﻭ ُﺮْﻬَّﺼﻟﺍ َّﻢُﺛ
ُﺩﺎَﻌُﻳ ﺎَﻤَﻛ .َﻥﺎَﻛ ‘ফুটন্ত উত্তপ্ত
পানি কাফেরদের মাথায় ঢালা হবে, যা
তাদের মাথা ছিদ্র করে পেটে গিয়ে
পৌঁছবে এবং পেটে যা কিছু আছে তা বের
করে ফেলবে এবং তার পেট থেকে বের হয়ে
পায়ে এসে পড়বে। আর এটাই ُﺮْﻬَّﺼﻟﺍ
শব্দের ব্যাখ্যা। অতঃপর পুনরায় সে
পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাবে’ (এভাবেই
চলতে থাকবে শাস্তি)।[14]
(গ) জাহান্নামীদের খাদ্য :
জাহান্নাম গহবরে আগুনের লেলিহান
শিখা পাপী মানুষকে উপর-নীচ, ডান-
বাম সকল দিক থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে
ধরবে। সেখানে পার্থিব আগুনের ৭০
গুণ উত্তাপ সম্পন্ন এই মহা হুতাশনে
জাহান্নামের অধিবাসীরা দাউ দাউ করে
জ্বলতে থাকবে। সেখানে তাদের কোন
সাহায্যকারী বন্ধু থাকবে না। থাকবে
না শান্তিদায়ক কোন উপাদান। সেখানে
শুধু থাকবে চূড়ান্ত দুঃখ, ধিক্কার,
অপমান, অনুতাপ আর লজ্জা। এ রকম
জটিল ও কঠিন মুহূর্তে তারা চরম
তৃষ্ণার্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে হাহাকার
করবে। কিন্তু কোথাও কোন ঠান্ডা
পানীয় ও উত্তম আহারের ব্যবস্থা
থাকবে না। থাকবে না পরিতৃপ্ত হওয়ার
মত কোন খাদ্য। থাকবে শুধু রক্ত,
দুর্গন্ধযুক্ত পুঁজ, কাঁটাযুক্ত বৃক্ষের
ফল, সর্বাধিক কদর্যপূর্ণ নোংরা এবং
গলায় আটকে যাওয়া খাবার প্রভৃতি।
পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে
জাহান্নামীদের মোট চার ধরনের
খাবারের কথা বর্ণিত হয়েছে। যা
নিম্নে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হ’ল-
১. ﻡﻮُّﻗَﺯ(তেতো ফলবিশিষ্ট এক
প্রকারের কাঁটাযুক্ত বৃক্ষ) :
দুর্গন্ধযুক্ত তেতো কাঁটাযুক্ত এক
প্রকার ভারী খাবারকে ﻡﻮُّﻗَﺯবলে। যা
খাদ্য হিসাবে জাহান্নামীদের দেওয়া
হবে। তা জাহান্নামের নিম্নদেশ থেকে
উদ্গত হবে। এর গুচ্ছ হবে শয়তানের
মস্তকের ন্যায়। কাফেররা সেখানে এটা
ভক্ষণ করবে এবং তাদের উদর পূর্ণ
করবে। এটি এমন একটি বৃক্ষ যা
দুনিয়ায় পাওয়া যায় না। মহান আল্লাহ
জাহান্নামের বিভিন্ন শাস্তির মত
এটাকেও সৃষ্টি করবেন।[15] এ মর্মে
মহান আল্লাহ বলেন, َﻚِﻟَﺫَﺃ ٌﺮْﻴَﺧ
ﺎًﻟُﺰُﻧ ْﻡَﺃ ُﺓَﺮَﺠَﺷ ،ِﻡْﻮُّﻗَّﺰﻟﺍ ﺎَّﻧِﺇ
ﺎَﻫﺎَﻨْﻠَﻌَﺟ ًﺔَﻨْﺘِﻓ ،َﻦْﻴِﻤِﻟﺎَّﻈﻠِﻟ
ﺎَﻬَّﻧِﺇ ٌﺓَﺮَﺠَﺷ ُﺝُﺮْﺨَﺗ ْﻲِﻓ ِﻞْﺻَﺃ
،ِﻢْﻴِﺤَﺠْﻟﺍ ﺎَﻬُﻌْﻠَﻃ ُﻪَّﻧَﺄَﻛ ُﺱْﻭُﺀُﺭ
،ِﻦْﻴِﻃﺎَﻴَّﺸﻟﺍ ْﻢُﻬَّﻧِﺈَﻓ َﻥْﻮُﻠِﻛﺂَﻟ
ﺎَﻬْﻨِﻣ َﻥْﻮُﺌِﻟﺎَﻤَﻓ ﺎَﻬْﻨِﻣ .َﻥْﻮُﻄُﺒْﻟﺍ
‘আপ্যায়নের জন্য কি এটাই শ্রেষ্ঠ,
নাকি যাক্কূম বৃক্ষ? এটাকে আমরা
অত্যাচারীদের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ
তৈরী করেছি। এ বৃক্ষ উদ্গত হয়
জাহান্নামের তলদেশ থেকে। তার গুচ্ছ
যেন শয়তানের মস্তকের ন্যায়।
অবশ্যই তারা এটা হ’তে ভক্ষণ করবে
এবং তাদের পেট পূর্ণ করবে’ (ছাফফাত
৩৭/৬২-৬৬) ।
উল্লেখ্য যে, যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
যাক্কূম গাছের কথা বলে মানুষদের
জাহান্নাম সম্পর্কে ভয় প্রদর্শন
করতেন, তখন আবূ জাহল তার সাথীদের
উদ্দেশ্য করে বলত যে, তোমরা শুন!
আগুনে নাকি গাছ হবে? অথচ আগুন
গাছকে খেয়ে ফেলে। এটা কোন ধরনের
কথা? তখন আল্লাহ ﺎَﻬَّﻧِﺇ ٌﺓَﺮَﺠَﺷ
ُﺝُﺮْﺨَﺗ ْﻲِﻓ ِﻞْﺻَﺃ ِﻢْﻴِﺤَﺠْﻟﺍ আয়াতটি
নাযিল করে তাদেরকে কঠোরভাবে
জওয়াব দেন। মূলতঃ যাক্কূম গাছ আগুন
থেকেই তৈরী এবং আগুনই তার খাদ্য’।
[16]
২. ٌﻊﻳِﺮَﺿ (সর্বাধিক কদর্যপূর্ণ
কাঁটাযুক্ত শুষ্ক নোংরা খাবার) : মূলত
ﻊﻳِﺮَﺿআগুনের একটি বৃক্ষের নাম এবং
জাহান্নামের পাথর। এতে বিষাক্ত
কণ্টক বিশিষ্ট ফল ধরে থাকবে। এটা
হবে দুর্গন্ধযুক্ত খাদ্য ও অত্যন্ত
নিকৃষ্ট আহার্য। এটা ভক্ষণে দেহ
পরিপুষ্টও হবে না, ক্ষুধাও নিবৃত হবে
না এবং অবস্থার কোন পরিবর্তন হবে
না।[17] আল্লামা ত্বানতাবী (রহঃ)
বলেন, এটি জাহান্নামীদেরর প্রদত্ত
আযাবের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে একটি
স্তরের আযাব। তাদের মধ্যে কেউ
যাক্কূম, কেউ গিসলীন আবার কেউ যরী‘
ভোগ করবে।[18] ইমাম বুখারী (রহঃ)
মুজাহিদের সূত্রে বলেন, এটি
একপ্রকার কাঁটাযুক্ত গুল্ম। তা যখন
সবুজ থাকে তখন তাকে ﻊﻳِﺮَﺿবলা হয়,
আর যখন শুকিয়ে যায় তখন
হিজাযবাসীরা একেই ﻊﻳِﺮَﺿবলে। এটা
এক প্রকার বিষাক্ত আগাছা।[19] এ
প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, َﺲْﻳَﻝ
ْﻢُﻬَﻟ ٌﻡﺎَﻌَﻃ َّﻻِﺇ ْﻦِﻣ ،ٍﻊْﻳِﺮَﺿ َﻻ ُﻦِﻤْﺴُﻳ
َﻻَﻭ ْﻲِﻨْﻐُﻳ ْﻦِﻣ .ٍﻉْﻮُﺟ ‘তাদের জন্য
বিষাক্ত কাঁটাযুক্ত গুল্ম ছাড়া কোন
খাবার থাকবে না। যা তাদের পরিপুষ্টও
করবে না এবং ক্ষুধাও নিবৃত করবে না’
(গা-শিয়াহ ৮৮/৫-৭) ।
৩. ﺍَﺫ ٍﺔَّﺼُﻏ (গলায় আটকে যাওয়া
খাবার) : এটি এমন খাবার যা
কণ্ঠনালীতে আটকে থাকে এবং যেখান
থেকে কোন কিছু বের হ’তে পারে না ও
কোন কিছু ঢুকতেও পারে না। বরং
কদর্যতা, দুর্গন্ধ ও তিক্ততার কারণে
সেখানে তা আটকে থাকে।[20] অন্যত্র
কাঁটাযুক্ত খাবার গলায় আটকে যাওয়ার
কথা বলা হয়েছে। এমনভাবে তাদের
প্রতি শাস্তি অব্যাহত থাকবে।[21] এ
প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,َّﻥِﺇ
ﺎَﻨْﻳَﺪَﻟ ًﻻﺎَﻜْﻧَﺃ ،ﺎًﻤْﻴِﺤَﺟَﻭ ﺎًﻣﺎَﻌَﻃَﻭ
ﺍَﺫ ٍﺔَّﺼُﻏ ﺎًﺑﺍَﺬَﻋَﻭ .ﺎًﻤْﻴِﻟَﺃ ‘আমাদের
নিকটে রয়েছে শৃঙ্খল ও প্রজ্বলিত
বহ্নিশিখা। আর আছে এমন খাদ্য যা
গলায় আটকে যায় এবং যন্ত্রণাদায়ক
কঠিন শাস্তি’ (মুযযাম্মিল
৭৩/১২-১৩) ।
৪. ٍﻦْﻴِﻠْﺴِﻏ(রক্ত ও পুঁজ) : এ বিষয়ে
পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
(ঘ) জাহান্নামের আগুন :
জাহান্নামের আগুনের তীব্রতা বর্ণনায়
মহান আল্লাহ বলেন, ﺎَّﻠَﻛ ﺎَﻬَّﻧِﺇ
،ﻰَﻈَﻟ ًﺔَﻋﺍَّﺰَﻧ ،ﻯَﻮَّﺸﻠِﻟ ﻮُﻋْﺪَﺗ ْﻦَﻣ
َﺮَﺑْﺩَﺃ ،ﻰَّﻟَﻮَﺗَﻭ َﻊَﻤَﺟَﻭ .ﻰَﻋْﻭَﺄَﻓ ‘না,
কখনো নয়, এটাতো (লাযা) লেলিহান
অগ্নিশিখা। যা চামড়া তুলে দিবে। সে
ঐ ব্যক্তিকে আহবান করবে যে, (সত্যের
প্রতি) পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেছিল এবং
বিমুখ হয়েছিল, সম্পদ পুঞ্জীভূত
করেছিল এবং তা আগলে রেখেছিল’
(মা‘আরিজ ৭০/১৫-১৮) ।
আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নামের আগুন
প্রজ্বলিত করার জন্য অত্যন্ত রুক্ষ্ম,
নির্দয় এবং কঠোর স্বভাব সম্পন্ন
ফেরেশতা নিযুক্ত করে রেখেছেন।
যাদের সংখ্যা হবে ১৯ জন। এ মর্মে
তিনি বলেন, ﺍَﻱ ﺎَﻬُّﻳَﺃ َﻦْﻳِﺬَّﻟﺍ
ﺍْﻮُﻨَﻣﺁ ﺍْﻮُﻗ ْﻢُﻜَﺴُﻔْﻧَﺃ ْﻢُﻜْﻴِﻠْﻫَﺃَﻭ
ﺍًﺭﺎَﻧ ﺎَﻫُﺩْﻮُﻗَﻭ ُﺱﺎَّﻨﻟﺍ ُﺓَﺭﺎَﺠِﺤْﻟﺍَﻭ
ﺎَﻬْﻴَﻠَﻋ ٌﺔَﻜِﺋَﻼَﻣ ٌﻅَﻼِﻏ ٌﺩﺍَﺪِﺷ َﻻ
َﻥْﻮُﺼْﻌَﻳ َﻪﻠﻟﺍ ﺎَﻣ َﻥْﻮُﻠَﻌْﻔَﻳَﻭ ْﻢُﻫَﺮَﻣَﺃ
ﺎَﻣ .َﻥْﻭُﺮَﻣْﺆُﻳ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা
নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-
পরিজনকে রক্ষা কর ঐ আগুন থেকে, যার
ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। যাতে
নিয়োজিত আছে পাষাণ হৃদয়, কঠোর
স্বভাবের ফেরেশতাগণ, যারা অমান্য
করেন না আল্লাহ্র কোন নির্দেশ। যা
করতে আদিষ্ট হন তারা কেবলমাত্র তাই
করেন’ (তাহরীম ৬৬/৬) । আর
জাহান্নামের ওপর প্রহরী হিসাবে
নিয়োজিত রয়েছে ১৯ ফেরেশতা
(মুদ্দাচ্ছির ৭৪/৩০) ।
জাহান্নামের প্রহরীরা জাহান্নামের
আগুন অনবরত প্রজ্বলিত করছে এবং
সর্বদা করবে। যা কখনো শীতল হবে
না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﺎَﻤَّﻠُﻛ ْﺖَﺒَﺧ
ْﻢُﻫﺎَﻧْﺩِﺯ ﺍًﺮْﻴِﻌَﺳ ‘যখনই (আগুন)
স্তিমিত হয়ে যাওয়ার উপক্রম হবে,
তখনই আমরা তাদের জন্য আগুন আরো
বৃদ্ধি করে দেব’ (বনী ইসরাঈল
১৭/৯৭) ।
পৃথিবীতে প্রজ্বলিত আগুনের তুলনায়
জাহান্নামে আগুন ৬৯ গুণ অধিক উত্তাপ
সম্পন্ন। আর তার প্রতিটি অংশের
উত্তাপের তীব্রতা দুনিয়ার আগুনের
তীব্রতার ন্যায়। মূলতঃ তার তীব্রতা
ও প্রচন্ডতা এত শক্তিশালী যে তা
ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। এ মর্মে
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
ْﻢُﻛُﺭﺎَﻧ ِﻩِﺬَﻫ ْﻰِﺘَّﻟﺍ ُﺪِﻗْﻮُﻳ ُﻦْﺑﺍ َﻡَﺩﺁ
ٌﺀْﺰُﺟ ْﻦِﻣ َﻦْﻴِﻌْﺒَﺳ ﺍًﺀْﺰُﺟ ْﻦِﻣ ِّﺮَﺣ َﻢَّﻨَﻬَﺟ
ﺍْﻮُﻟﺎَﻗ ِﻪﻠﻟﺍَﻭ ْﻥِﺇ ْﺖَﻧﺎَﻛ ًﺔَﻴِﻓﺎَﻜَﻟ
ﺎَﻳ َﻝْﻮُﺳَﺭ ِﻪﻠﻟﺍ َﻝﺎَﻗr ﺎَﻬَّﻧِﺈَﻓ
ْﺖَﻠِّﻀُﻓ ﺎَﻬْﻴَﻠَﻋ ٍﺔَﻌْﺴِﺘِﺑ َﻦْﻴِّﺘِﺳَﻭ ﺍًﺀْﺰُﺟ
ﺎَﻬُّﻠُﻛ ُﻞْﺜِﻣ .ﺎَﻫِّﺮَﺣ
‘তোমাদের এই আগুন যা বনী আদম
প্রজবলিত করে তা জাহান্নামের
আগুনের তীব্রতার সত্তর ভাগের এক
ভাগ। ছাহাবীগণ বলল, হে আল্লাহ্র
রাসূল (ছাঃ)! আল্লাহ্র কসম! সে আগুন
পৃথিবীর ন্যায় হওয়াই তো যথেষ্ট
ছিল। তখন তিনি বললেন, তাকে
দুনিয়ার আগুনের চেয়ে ৬৯ গুণ অধিক
উত্তাপ সম্পন্ন করা হয়েছে। আর তার
প্রত্যেকটি ভাগ দুনিয়ার আগুনের মত
উত্তাপ সম্পন্ন হবে’।[22]
জাহান্নামের আগুন এত দাহ্যশক্তি
সম্পন্ন হবে যে, সেখানে জাহান্নামীরা
জ্বলতে জ্বলতে কয়লায় পরিণত হবে।
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,
নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,
ُﻞُﺧْﺪَﻳ ُﻞْﻫَﺃ ِﺔَّﻨَﺠْﻟﺍ َﺔَّﻨَﺠْﻟﺍ ُﻞْﻫَﺃَﻭ
ِﺭﺎَّﻨﻟﺍ َﺭﺎَّﻨﻟﺍ َّﻢُﺛ ُﻝْﻮُﻘَﻳ ُﻪﻠﻟﺍ
ﻰَﻟﺎَﻌَﺗ ﺍْﻮُﺟِﺮْﺧَﺃ ْﻦَﻣ َﻥﺎَﻛ ْﻰِﻓ ِﻪِﺒْﻠَﻗ
ُﻝﺎَﻘْﺜِﻣ ٍﺔَّﺒَﺣ ْﻦِﻣ ٍﻝَﺩْﺮَﺧ ْﻦِﻣ ٍﻥﺎَﻤْﻳِﺇ
َﻥْﻮُﺟَﺮْﺨُﻴَﻓ ﺎَﻬْﻨِﻣ ِﺪَﻗ ﺍْﻭُّﺩَﻮْﺳﺍ
َﻥْﻮَﻘْﻠُﻴَﻓ ْﻰِﻓ ِﺮَﻬَﻧ ﺎَﻴَﺤْﻟﺍ ِﻭَﺃ
ِﺓﺎَﻴَﺤْﻟﺍ َّﻚَﺷ ٌﻚِﻟﺎَﻣ َﻥْﻮُﺘُﺒْﻨَﻴَﻓ ﺎَﻤَﻛ
ُﺖُﺒْﻨَﺗ ُﺔَّﺒَﺤْﻟﺍ ْﻰِﻓ ِﺐِﻧﺎَﺟ ِﻞْﻴَّﺴﻟﺍ
ْﻢَﻟَﺃ َﺮَﺗ ﺎَﻬَّﻧَﺃ ُﺝُﺮْﺨَﺗ َﺀﺍَﺮْﻔَﺻ
.ًﺔَﻳِﻮَﺘْﻠُﻣ
‘জান্নাতীরা জান্নাতে ও জাহান্নামীরা
জাহান্নামে প্রবেশ করার পর আল্লাহ
বলবেন, যার অন্তরে অণু পরিমাণ ঈমান
আছে তাকে জাহান্নাম থেকে বের কর।
তখন জাহান্নাম থেকে তাদের বের করে
আনা হবে। সে সময় তারা প্রজ্বলিত
কয়লার ন্যায় হবে। তখন তাদের আবার
হায়া বা হায়াত (বর্ণনাকারী মালেক-
এর সন্দেহ) নামক নদীতে নিক্ষেপ
করা হবে। এতে তারা সেখানে নতুন
জীবন লাভ করবে। যেমনভাবে নদীর
তীরে চারা গজায়। নবী করীম (ছাঃ)
বললেন, তোমরা কি দেখনি যে, নদীর
তীরে চারা গাছ যেমন হলুদ বর্ণের
পেচানো অবস্থায় জন্ম নেয়’।[23] এ
প্রসঙ্গে আরো বর্ণিত হয়েছে,
ْﻦَﻋ ٍﺮِﺑﺎَﺟ َﻝﺎَﻗ t َﻝﺎَﻗ ُﻝْﻮُﺳَﺭ ِﻪﻠﻟﺍ
ُﺏَّﺬَﻌُﻳ r ٌﺱﺎَﻧ ْﻦِﻣ ِﻞْﻫَﺃ ِﺪْﻴِﺣْﻮَّﺘﻟﺍ ﻰِﻓ
ِﺭﺎَّﻨﻟﺍ ﻰَّﺘَﺣ ﺍْﻮُﻧْﻮُﻜَﻳ ﺎَﻬْﻴِﻓ ﺎًﻤَﻤُﺣ
َّﻢُﺛ ُﻢُﻬُﻛِﺭْﺪُﺗ ُﺔَﻤْﺣَّﺮﻟﺍ َﻥْﻮُﺟَﺮْﺨُﻴَﻓ
َﻥْﻮُﺣَﺮْﻄُﻳَﻭ ﻰَﻠَﻋ ِﺏﺍَﻮْﺑَﺃ ِﺔَّﻨَﺠْﻟﺍ َﻝﺎَﻗ
ُّﺵُﺮَﻴَﻓ ْﻢِﻬْﻴَﻠَﻋ ُﻞْﻫَﺃ ِﺔَّﻨَﺠْﻟﺍ َﺀﺎَﻤْﻟﺍ
َﻥْﻮُﺘُﺒْﻨَﻴَﻓ ﺎَﻤَﻛ ُﺖُﺒْﻨَﻳ ُﺀﺎَﺜُﻐْﻟﺍ ْﻰِﻓ
ِﺔَﻟﺎَﻤِﺣ ِﻞْﻴَّﺴﻟﺍ َّﻢُﺛ َﻥْﻮُﻠُﺧْﺪَﻳ
.َﺔَّﻨَﺠْﻟﺍ
জাবের (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
বলেছেন, ‘তাওহীদপন্থীদের মধ্যে কিছু
ব্যক্তিদের জাহান্নামে শাস্তি দেওয়া
হবে। এমনকি তারা জ্বলতে জ্বলতে
কয়লায় পরিণত হবে। অতঃপর তারা
আল্লাহ্র রহমত লাভ করবে, তখন
তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করা
হবে। তারপর জান্নাতের দরজায়
তাদেরকে বসিয়ে দেওয়া হবে। তারপর
তিনি বলেন, জান্নাতবাসীগণ তাদের
উপর পানি প্রবাহিত করে দিবে। তখন
তারা এমনভাবে উঠে দাঁড়াবে, যেমন কোন
বীজ বন্যার পানিতে ভেসে এসে নতুন
চারা জন্মায়। অতঃপর তারা জান্নাতে
প্রবেশ করবে’।[24]
তাছাড়া সেখানে সঊদ নামক একটি
আগুনের পাহাড় রয়েছে এবং
জাহান্নামীদের পরিধেয় বস্ত্র,
বিছানাপত্র, ছাতা-বেষ্টনীসহ সবকিছু
হবে অগ্নি নির্মিত। যা ব্যবহারের
মাধ্যমে তাদেরকে শাস্তির চরম
সীমায় পৌঁছানো হবে।
[চলবে]
[1]. বুখারী হা/৩২৩৬ ‘সৃষ্টি সূচনা’
অধ্যায়।
[2]. মুসলিম হা/২১৪০; মিশকাত
হা/২৯৪২; মুসনাদে আহমাদ
হা/১৪৪৫৭; ছহীহুল জামে‘ হা/৭৮৬৬।
[3]. বুখারী হা/৫৩৬-৫৩৭; মুসলিম
হা/১৪৩২; মিশকাত হা/৫৯১; দারেমী
হা/২৮৪৫।
[4]. ড.ওমর ইবনু সুলায়মান আল-
আশকার, আল-জান্নাতু ওয়ান্নার, ১৬৯
পৃঃ।
[5]. আল-জান্নাতু ওয়ান্নার, পৃঃ ১৬৮।
[6]. ঐ।
[7]. ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, আল-
মু‘জামুল ওয়াফী, (ঢাকা : রিয়াদ
প্রকাশনী, ১১শ সংস্করণ, জানুয়ারী
২০০৫), পৃঃ ৬২৫।
[8]. তাফসীরে ত্বাবারী ২২/৪৬ পৃঃ।
[9]. তাফসীরে কুরতুবী ১০/৩৯৪ পৃঃ;
আদ-দুররুল মানছূর ৫/৩৮৫ পৃঃ,
তাফসীরে ইবনু কাছীর ৫/১৫৪ পৃঃ।
[10]. বাহরুল ঊলূম ২/৩৪৫ পৃঃ।
[11]. আদ-দুররুল মানছুর ৩/১৭৫ ও
৭/২৪২ পৃঃ; তাফসীর ইবনু কাছীর
৩/১৮৭ পৃঃ; তাফসীরে খাযেন ১/২০৯
পৃঃ।
[12]. মুসলিম হা/৫৩৩৫; মিশকাত
হা/৩৬৩৯।
[13].আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/৫৫৭;
তিরমিযী হা/২৪৯২; মিশকাত
হা/৫১১২; ছহীহুল জামে‘ হা/৮০৪০।
[14]. মুসনাদে আহমাদ হা/৮৮৫১;
শারহুস সুন্নাহ হা/৪৪০৬
‘জাহান্নামের বৈশিষ্ট্য ও তার
অধিবাসী’ অনুচ্ছেদ; মুসনাদে ইবনু
মুবারক হা/১২৮; ছহীহ আত-তারগীব
ওয়াত-তারহীব হা/৩৬৭৯, হাদীছ
হাসান।
[15]. তাফসীরে ত্বানত্বাবী, পৃঃ
৪০৬৬।
[16]. তাফসীর ইবনু কাছীর ৭/২০ পৃঃ
‘উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য’।
[17]. তাফসীর ইবনু কাছীর ৮/৩৮৫
পৃঃ; আদ-দুররুল মানছুর ৮/৪৯১ পৃঃ।
[18]. তাফসীরে ত্বানত্বাবী পৃঃ
৪৪৯৩।
[19]. তাফসীরে ইবনু কাছীর ৮/৩৮৫
পৃঃ; বুখারী ২/৭৩৬ পৃঃ,
অনুচ্ছেদ-৮৮।
[20]. তাফসীরে ত্বানত্বাবী ৪৩৬১
পৃঃ; তাফসীর ইবনু কাছীর ৮/২৫৬
পৃঃ; তাফসীরে ত্বাবারী ২৩/৬৯১ পৃঃ।
[21]. তাফসীরে বাহরুল ঊলূম ৩/৪৮৮
পৃঃ; তাফসীরে জালালাইন পৃঃ ৭৭৪;
তাফসীরে খাযেন ৭/১৬৯ পৃঃ;
তাফসীরে ত্বাবারী ২৩/৬৯১ পৃঃ;
তাফসীরে কুরতুবী ১৯/৪৬ পৃঃ।
[22]. মুসলিম হা/৭৩৪৪; তিরমিযী
হা/২৫৮৯।
[23]. বুখারী হা/২২; মুসলিম
হা/৪৭৫; মিশকাত হা/৫৫৮০।
[24]. তিরমিযী হা/২৫৯৭;
সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৪৫১;
ছহীহুল জামে‘ হা/৮১০৩।
-বযলুর রহমান