হালাল উপার্জনের গুরুত্ব

ইসলামে হালাল উপার্জন : গুরুত্ব ও তাৎপর্য
ইসলাম পরিপূর্ণ এক জীবন ব্যবস্থার নাম।
এতে মানবজীবনের ব্যক্তিগত পারিবারিক,
সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক
পরিমণ্ডলের যাবতীয় বিষয়ের সমাধানে
হিকমতপূর্ণ বিধানের বর্ণনা রয়েছে। এটি
মানুষের জন্য যা কল্যাণকর ও হিতকর সে
বিষয় বৈধ করত: সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে
এবং যাবতীয় অকল্যাণ ও ক্ষতিকর বিষয়
হতে মানবজাতিকে সর্তক করেছে। অতএব,
ইসলাম মানবজাতির জন্য কল্যাণের আঁধার
হিসেবে শান্তির বার্তা নিয়ে আবির্ভূত
হয়েছে। মানবদেহের জীবনীশক্তি হিসেবে
রক্তের যে গুরুত্ব রয়েছে, মানবজীবনে অর্থের
গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাও তেমনি
তাৎপর্যপূর্ণ। ফলে অর্থ মানব জীবনের
অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর এর জন্য প্রয়োজন
মেধা, শ্রম ও সময়ের যথোপযুক্ত ব্যবহার।
জীবন নির্বাহের এ মাধ্যমটিই পেশা
হিসেবে পরিগণিত। মহান আল্লাহ তা‘আলা
তাঁর নির্ধারিত ফরজ ইবাদত (যেমন নামায)
সম্পন্ন করার পর জীবিকা অন্বেষনে জমীনে
ছড়িয়ে পড়তে নির্দেশ দিয়েছেন। যাতে
সর্বশ্রেষ্ঠ জীব নিজেই জীবিকা অর্জনে
ব্রতী হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম নিজের পরিশ্রম লব্দ
উপার্জনকে সর্বোত্তম উপার্জন বলে
আখ্যায়িত করেছেন। তবে নিশ্চয় উপার্জনের
পন্থা শরীয়াত নির্ধারিত পন্থায় হতে হবে।
এমন উপার্জনকে ইসলাম অবৈধ ঘোষনা
করেছে, যাতে প্রতারনা, মিথ্যা, ধোঁকাবাজি,
জনসাধারণের অকল্যাণ সর্বোপরি জুলুম
রয়েছে। দুনিয়ার জীবনে অবৈধ পন্থায়
উপার্জন করে সুখ-সাচ্ছন্দ লাভ করলেও
পরকালীন জীবনে রয়েছে এর জন্য
জবাবদিহিতা ও সুবিচার। সে লক্ষে ইসলাম
হালাল উপার্জনের অপরিসীম গুরুত্ব প্রদান
করেছে। নিম্নে এসম্পর্কে আলোচনা প্রদত্ত
হলো:
উপার্জনের গুরুত্ব
খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা,
মানুষের মৌলিক অধিকার। এগুলোর যোগান
দিতে মানুষকে বেছে নিতে হয় সম্পদ
উপার্জনের নানাবিধ পন্থা। জীবিকা
নির্বাহের জন্য মানুষ যেসব পেশা অবলম্বন
করে তা হলো: কৃষি, ব্যবসা-বানিজ্য, চাকুরী,
শিল্প প্রভৃতি। উপার্জনের মাধ্যম ব্যতীত
কোন ব্যক্তির পক্ষেই উপর্যুক্ত মৌলিক
অধিকার সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। মানুষকে
মহান আল্লাহ সৃষ্টির শ্রেষ্ট জীব হিসেবে
সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হননি; বরং তাদের
যাবতিয় মৌলিক অধিকারও সংরক্ষণের
ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সে লক্ষে তিনি
মহাশুণ্যের সব সৃষ্টিকে মানুষের সেবায়
নিয়োজিত করেছেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ
হয়েছে:
﴿ َﻮُﻫ ﻱِﺬَّﻟﭐ َﻖَﻠَﺧ ﻢُﻜَﻟ ﺎَّﻣ ﻲِﻓ ِﺽۡﺭَﺄۡﻟﭐ
ﺎٗﻌﻴِﻤَﺟ َّﻢُﺛ ٰٓﻯَﻮَﺘۡﺳﭐ ِﺀﺂَﻤَّﺴﻟﭐ ﻰَﻟِﺇ
َّﻦُﻬٰﻯَّﻮَﺴَﻓ َﻊۡﺒَﺳ ٖۚﺕَٰﻮَٰﻤَﺳ َﻮُﻫَﻭ ِّﻞُﻜِﺑ ٍﺀۡﻲَﺷ ٞﻢﻴِﻠَﻋ
﴾٢٩ ‏[ 29:ﺓﺮﻘﺒﻟﺍ ]
‘‘তিনিই সেই মহান সত্তা, যিনি পৃথিবীর
সবকিছু তোমাদের (ব্যবহারের জন্য) তৈরী
করেছেন।’’[1]
তবে এক্ষেত্রে তিনি মানুষকে দিয়েছেন পূর্ণ
স্বাধীনতা যা তার ইখতিয়ারভুক্ত একান্ত
নিজস্ব ব্যাপার। ফলে প্রত্যেকে স্ব-স্ব
যোগ্যতা, মেধা, শ্রম ও সময়ের যথোপযুক্ত
ব্যবহারের মাধ্যেমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি
অর্জনের প্রয়াস চালায়।
মানবজীবনে অর্থনীতির গুরুত্ব অপরিসীম।
এটি মানুষের জীবন নির্বাহের অন্যতম
চালিকা শক্তি হিসেবে সমাদৃত, মানব
জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে
পরিগণিত। মহান আল্লাহ মানুষকে এর
গুরুত্ব অনুধাবন বোধগম্য করার নিমিত্তে
পবিত্র কুরআনে সালাতের পাশাপাশি যাকাত
তথা অর্থের উল্লেখ ৮২ স্থানে করেছেন। শুধু
তাই নয়, মহান আল্লাহ অর্থনৈতিক বিধানও
নির্দেশ করেছেন। ফলে কুরআনুল কারিমকে
একটি অর্থবিদ্যার মহাকোষ বললেও
অত্যুক্তি হবে না। মানুষ কিভাবে উপার্জন
করবে, কোন পন্থায় তা ব্যয় করবে এবং
উপার্জনের ক্ষেত্রে যাবতীয় অর্জনীয় ও
বর্জনীয় গুণাবলীর সম্পর্কে এর সুষ্পষ্ট
নির্দেশনা বিদ্যমান। তাইতো ব্যক্তির
উপার্জিত সম্পদে তিনি যাকাত ফরয
করেছেন, যেন সম্পদ এক শ্রেণির লোকদের
মাঝে সীমাবদ্ধ না থাকে। আল্লাহ তা‘আলা
ফরয ইবাদত সমাপনান্তে জীবিকা নির্বাহে
উপার্জন করার লক্ষ্যে যমিনে ছড়িয়ে পড়তে
নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন:
﴿ ﺍَﺫِﺈَﻓ ِﺖَﻴِﻀُﻗ ُﺓٰﻮَﻠَّﺼﻟﭐ ْﺍﻭُﺮِﺸَﺘﻧﭑَﻓ ﻲِﻓ
ْﺍﻮُﻐَﺘۡﺑﭐَﻭ ِﺽۡﺭَﺄۡﻟﭐ ﻦِﻣ ِﻪَّﻠﻟﭐ ِﻞۡﻀَﻓ
ْﺍﻭُﺮُﻛۡﺫﭐَﻭ ﺍٗﺮﻴِﺜَﻛ َﻪَّﻠﻟﭐ َﻥﻮُﺤِﻠۡﻔُﺗ ۡﻢُﻜَّﻠَﻌَّﻟ
﴾ ‏[ 10:ﺔﻌﻤﺠﻟﺍ ]
‘‘সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে
ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান
করবে, এবং আল্লাহকে অধিক স্মরন করবে
যাতে তোমরা সফলকাম হও[2]।’’
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবী (র.)
বলেন:
ﺍﺫﺎﻓ ﻢﺘﻏﺮﻓ ﻦﻣ ﺓﻼﺼﻟﺍ ﺍﻭﺮﺸﺘﻧﺎﻓ ﻲﻓ
ﺽﺭﻷﺍ ﻉﺮﺼﺘﻟﺍﻭ ﺓﺭﺎﺠﺘﻠﻟ ﻢﻜﺠﺋﺍﻮﺣ ﻲﻓ
‘‘যখন নামায শেষ হয়ে যাবে, তখন তোমরা
ব্যবসায়িক কাজকর্ম ও অন্যান্য পার্থিব
প্রয়োজনাদি পূরণে বেড়িয়ে পড়ো[3]।’’
এখানে উপার্জনের একটি মূলনীতি
সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে। আর তাহলো
এমন পন্থা অবলম্বন করতে হবে, যাতে
আল্লাহর স্মরণে ব্রত থাকা যায়।
অতএব, যেসব পেশায় বা উপার্জনের পন্থায়
আল্লাহর স্মরণে বিমুখ হওয়ার সম্ভাবনা
রয়েছে ইসলাম তা অবৈধ হিসেবে ঘোষনা
করেছে। পবিত্র কুরআনে অন্যত্র এ বিষয়ে
প্রমাণ পাওয়া যায়। সেটি হলো ব্যবসায়ের
ক্ষেত্রে যদি কখনও আল্লাহর স্মরণে ব্রত
হওয়ার আহবান আসে, তাহলে তখন যাবতীয়
ব্যবসায়িক কর্ম পরিহার করা সকল
ইমানদারদের জন্য ওয়াজিব।[4]
জীবিকা অর্জনের নিমিত্তে বিদেশে পাড়ি
জমানোরও নির্দেশও রয়েছে এবং এটিকে
আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়ার সমপর্যায়ভুক্ত
বলে গণ্য করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন:
﴿ َﻥﻮُﺑِﺮۡﻀَﻳ َﻥﻭُﺮَﺧﺍَﺀَﻭ ﻲِﻓ َﻥﻮُﻐَﺘۡﺒَﻳ ِﺽۡﺭَﺄۡﻟﭐ
ﻦِﻣ ِﻞۡﻀَﻓ َﻥﻮُﻠِﺘَٰﻘُﻳ َﻥﻭُﺮَﺧﺍَﺀَﻭ ِﻪَّﻠﻟﭐ ﻲِﻓ
ِﻞﻴِﺒَﺳ ﴾ِۖﻪَّﻠﻟﭐ ‏[ 9:ﺔﻌﻤﺠﻟﺍ ]
‘‘আল্লাহ জানেন যে, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ
অসুস্থ হয়ে পড়বে, কেউ আল্লাহর অনুগ্রহের
সন্ধানে দেশভ্রমন করবে এবং কেউ কেউ
আল্লাহর পথে যুদ্ধে লিপ্ত হবে।’’[5]
ﻦﻳﺮﻓﺎﺴﻣ ﻱﺃ ﻲﻓ ﻥﻮﻐﺘﺒﻳ ﺽﺭﻷﺍ ﻦﻣ ﻞﻀﻓ
ﻪﻠﻟﺍ ﺐﺳﺎﻜﻤﻟﺍ ﻲﻓ ﺮﺟﺎﺘﻤﻟﺍﻭ .
আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে
কাসীর (রহ.) বলেন:
‘‘অর্থ্যাৎ যারা ব্যবসা-বানিজ্য ও রিযিক
উপার্জনের বিভিন্ন উপায় অবলম্বনের
মাধ্যমে আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের অন্বেষায়
পৃথিবীতে ভ্রমনরত।[6]’’
তাছাড়া ব্যক্তি জীবনে অর্থনৈতিক
স্বাবলম্বী হওয়ার ব্যাপারে বিশ্বনবী
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
এমনভাবে উৎসাহিত করেছেন যে,
ভিক্ষাবৃত্তিকে তিনি নিন্দা করেছেন। এ
মর্মে যুবাইর ইবনে ‘আউয়াম রাদিয়াল্লাহু
আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« ﻥﻷ ،ﻢﻛﺪﺣﺃ ﻭﺪﻐﻳ ﺐﻄﺤﻴﻓ ﻰﻠﻋ ،ﻩﺮﻬﻇ
ﻕﺪﺼﺘﻴﻓ ﻲﻨﻐﺘﺴﻳﻭ ﻪﺑ ﻪﺑ ،ﺱﺎﻨﻟﺍ ﻦﻣ
ﺮﻴﺧ ﻪﻟ ﻦﻣ ﻥﺃ ﻝﺄﺴﻳ ،ﻼﺟﺭ ﻩﺎﻄﻋﺃ ﻭﺃ
ﻪﻌﻨﻣ ﻚﻟﺫ »
‘‘তোমাদের কেউ তার রশি নিয়ে চলে যাক,
পিঠে কাঠের বোঝা বহন করে এনে বিক্রয়
করুক এবং তার চেহারাকে আল্লাহর আযাব থেকে
বাঁচিয়ে রাখুক এটা তার জন্য মানুষের নিকট
ভিক্ষা করা, চাই তাকে দান করুক বা না করুক
তার চাইতে উত্তম।’’[7]
অতএব উপার্জন করার মনোবৃত্তি ব্যতিরেকে
যারা ভিক্ষাবৃত্তিতে প্রবৃত্ত হয় তাদের এ
ধরনের পেশাকে অবৈধ সাব্যস্ত করা হয়েছে।
এ মর্মে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেন:
« ﺎﻣ ﻞﺟﺮﻟﺍ ﻝﺍﺰﻳ ﻝﺄﺴﻳ ،ﺱﺎﻨﻟﺍ ﻰﺘﺣ
ﻲﺗﺄﻳ ﻡﻮﻳ ﺔﻣﺎﻴﻘﻟﺍ ﺲﻴﻟ ﻲﻓ ﻪﻬﺟﻭ
ﺔﻋﺰﻣ ﻢﺤﻟ »
‘‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সর্বদা মানুষের
কাছে চেয়ে বেড়ায় সে কিয়ামতের দিন এমন
অরস্থায় আগমন করবে যে, তার মুখমণ্ডলে এক
টুকরো গোশতও থাকবে না।[8]’’
ইসলাম মানবতার ধর্ম। দুস্থ মানবতার সেবায়
দান করার রীতি ইসলামে চালু আছে। তবে
ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে
ইসলাম অনুমোদন দেয় নি। বরং একে বার বার
নিরুৎসাহিত করেছে যা, নিষেধের পর্যায়
পৌঁছে গিয়েছে।
উপার্জনের ক্ষেত্রে ইসলাম নিজ হাতে
উপার্জন করাকে সর্বোত্তম উপার্জন হিসেবে
আখ্যায়িত করেছে। এ মর্মে হাদীসে এসেছে:
ﻦﻋ ﻊﻓﺍﺭ ﻦﺑ ،ﺞﻳﺪﺧ :ﻝﺎﻗ :ﻞﻴﻗ ﺎﻳ
ﻝﻮﺳﺭ ،ﻪﻠﻟﺍ ﺐﺴﻜﻟﺍ ﻱﺃ ؟ﺐﻴﻃﺃ :ﻝﺎﻗ
‏«ﻞﻤﻋ ﻞﺟﺮﻟﺍ ﻩﺪﻴﺑ ﻞﻛﻭ ﺭﻭﺮﺒﻣ ﻊﻴﺑ »
হযরত রাফে ইবনে খাদীজা রাদিয়াল্লাহু
আনহা হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন,
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে
জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, সর্বোত্তম
উপার্জন কোনটি? জবাবে তিনি বলেন:
ব্যক্তির নিজস্ব শ্রমলব্দ উপার্জন ও
সততার ভিত্তিতে ক্রয়-বিক্রয়।’’[9]
নবী রাসূলগণের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে
দেখা যায় যে, তাঁরা নিজ হাতে কর্ম
সম্পাদনকে অধিক পছন্দ করতেন। আমাদের
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
এর জীবনে প্রাথমিক সময়ে ছাগল চড়ানো ও
পরবর্তীতে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার
ব্যবসায়িক দায়িত্ব পালনের বর্ণনা পাওয়া
যায়, যা নিজ হাতে জীবিকা নির্বাহে
উৎকৃষ্ট প্রমাণ বহন করে।
ইসলামের দৃষ্টিতে হালাল উপার্জন
হালাল বলতে আমরা সাধারণত: যাবতীয় বৈধ
পন্থাকেই বুঝি। যা কল্যানকর ও হিতকর এবং
যাবতীয় অবৈধ ও অকল্যাণকর হতে মুক্ত।
ইসলামে হালাল উপার্জনের গুরুত্ব
অপরিসীম। মহান আল্লাহ মানব জাতিকে
উপার্জনের জন্যে উৎসাহ দিয়েই ক্ষান্ত
হননি; বরং যাবতীয় বৈধ ও অবৈধ পন্থাও
বাতলে দিয়েছেন। অতএব হালাল উপার্জন
বলতে বুঝায় উপার্জনের ক্ষেত্রে বৈধ ও
শরী‘আত সম্মত পন্থা অবলম্বন।
হালাল উপায়ে জীবিকা উপার্জনের ফলে সমাজ
ব্যবস্থায় ধনী দরিদ্রের মাঝে সুষম
ভারসাম্য ফিরে আসে; কৃষক দিন মজুর, ক্রেতা-
বিক্রেতা, শ্রমিক-মালিক এবং অধস্তনদের
সাথে উর্ধ্বতনদের সুদৃঢ় ও সংগতিপূণ সর্ম্পক
তৈরী হয়। ফলে সকল শ্রেণীর নাগরিকই
তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করার
সুযোগ পায় এবং সমাজ সংসারে নেমে আসে
শান্তির সুবাতাস।
মূলত: ইসলাম যে পেশাকে অবৈধ বলে ঘোষনা
করেছে সেসব পন্থায় উপার্জন ব্যতীত
অন্যান্য পন্থায় উপার্জন করা বৈধ বলে
বিবেচিত।[10] ইসলাম প্রদত্ত সীমারেখা ও
মূলনীতি ঠিক রেখে বৈধ যে কোন পণ্যের
ব্যবসা করার মাধ্যমে উপার্জনকে ইসলামী
শরী‘আত হালাল হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
এছাড়া যদি কেউ বৈধ উপায়ে যোগ্যতানুযায়ী
চাকুরী করে এবং ঘুষ সহ যাবতীয় অবৈধ লেন-
দেন ও অসৎ মানসিকতা থেকে দুরে থাকে তবে
সেটাও জীবিকার্জনের হালাল পন্থা হিসেবে
সাব্যস্ত হবে।
মহান আল্লাহ মানুষকে তাঁর ইবাদতের জন্য
সৃষ্টি করেছেন। এটি শুধুমাত্র পাঁচ ওয়াক্ত
নামায, রোযা, যাকাত প্রভৃতির উপরই
সীমাবদ্ধ নয়। জীবন ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ রূপ
রেখার প্রণেতা হিসেবে ইসলামে রয়েছে জীবন
ধারনের যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক
নির্দেশনা। এ দৃষ্টিকোন থেকে বিচার করলে
হালাল উপায়ে উপার্জনের ব্যবস্থা গ্রহণও
অন্যতম একটি মৌলিক ইবাদত। শুধু তাই নয়,
ইসলাম এটিকে অত্যাবশ্যক (ফরয) কাজ
হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
এ মর্মে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম এর একটি হাদীস
প্রনিধানযোগ্য। তিনি সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« ﺐﺴﻛ ﺔﻀﻳﺮﻓ ﻝﻼﺤﻟﺍ ﺪﻌﺑ ﺔﻀﻳﺮﻔﻟﺍ »
‘‘ফরয আদায়ের পর হালাল পন্থায় উপার্জনও
ফরয।’’[11]
উপর্যুক্ত হাদীসের মাধ্যমে প্রতিভাত হয়
যে, ইসলামে হালাল উপার্জনের গুরুত্ব
কতখানি এবং কোন ব্যক্তি যেন হারাম কোন
পেশা অবলম্বন না করে উপরোক্ত হাদীসে সে
মর্মেও অর্ন্তনিহীত নির্দেশ রয়েছে।
পরকালীন জীবনে এ ফরয ইবাদতটি সম্পর্কে
যে মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে তার
সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। কেননা যাবতীয়
ফরয সম্পর্কে বান্দা জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব
এটি ফরয কাজ সমূহের অন্তর্গত এক মৌলিক
অত্যাশ্যকীয় ইবাদতে গণ্য হয়েছে।
উপার্জনের ক্ষেত্রে ইসলাম যেসব পন্থাকে
হালাল করেছে সেগুলোর মূলনীতিসহ
সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে দেয়া হলো:
১.১ ব্যবসা বাণিজ্য
উপার্জনের ক্ষেত্রে ব্যবসা-বাণিজ্য সব চেয়ে
বড় সেক্টর। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি একটি
মহৎ পেশা। সমাজ জীবনে যার ক্রিয়াশীলতা
ও প্রভাব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও সুদূঢ়
প্রসারী। ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যকে শুধু
বৈধ বলেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং এ ব্যাপারে
সবিশেষ উৎসাহ ও গুরুত্ব প্রদান করেছে।
যেন মুসলিম উম্মাহ পৃথিবীর বুকে একটি
শ্রেষ্ট জাতি হিসেবে অর্থনৈতিকভাবে
সমৃদ্ধি ও স্বয়ং-সম্পূর্ণতা অর্জন করতে
পারে। মহান আল্লাহ বলেন:
﴿ َّﻞَﺣَﺃَﻭ ُﻪَّﻠﻟﭐ َﻊۡﻴَﺒۡﻟﭐ ْۚﺍٰﻮَﺑِّﺮﻟﭐ َﻡَّﺮَﺣَﻭ
﴾‏[ 275:ﺓﺮﻘﺒﻟﺍ ]
‘‘তিনি (আল্লাহ) ব্যবসাকে হালাল করেছেন
এবং সুদকে করেছেন হারাম।’’[12]
উপরোক্ত আয়াতের মর্ম উপলব্দিতে
প্রতীয়মান হয় যে, সুদভিত্তিক লেন-দেনের
মাধ্যমে যারা পৃথিবীতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি
অর্জন করছে তাদের মুকাবিলায় মহান আল্লাহ
ব্যবসা-বাণিজ্যকে বৈধ বলে ঘোষনা
দিয়েছেন। অতএব অবৈধ পন্থা হতে বাঁচার
এবং প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধি লাভের এটি অনেক
বড় অবলম্বণ। এছাড়াও জীবিকার একটি বৃহৎ
অংশ রয়েছে এ ব্যবস্থাপনায়। মুরসাল হাদীসে
বর্ণিত হয়েছে,
« ﻢﻜﻴﻠﻋ ﺓﺭﺎﺠﺘﻟﺎﺑ ﺎﻬﻴﻓ ﻥﺈﻓ ﺔﻌﺴﺗ
ﻕﺯﺮﻟﺍ ﺭﺎﺸﻋﺃ »
‘‘তোমরা ব্যবসা বানিজ্য কর। কারণ তাতেই
নিহিত রয়েছে নয়-দশমাংশ জীবিকা’’[13]
তাছাড়া সততা, বিশ্বস্ততা, ন্যায়পরায়নতা,
ধোঁকামুক্ত, কল্যাণমুখী মানসিকতাসম্পন্ন
ব্যবসায়ীদের প্রশংসায় রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনেক হাদীস
বিদ্যমান। এ ধরনের ব্যবসায়ীকে তিনি
নবীগণ, ছিদ্দিক, ও শহীদদের
সমমর্যাদাপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« ﻕﻭﺪﺼﻟﺍﺮﺟﺎﺘﻟﺍ ﻦﻴﻣﻷﺍ ﻦﻴﻴﺒﻨﻟﺍ ﻊﻣ
ﻦﻴﻘﻳﺪﺼﻟﺍﻭ ﺀﺍﺪﻬﺸﻟﺍﻭ »
‘‘সৎ ও ন্যায়পরায়ণ ব্যবসায়ী (পরকালে)
নবী, সিদ্দিকীন ও আল্লাহর পথে জীবন
বিসর্জনকারী শহীদদের সঙ্গী হবে।[14]
ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলাম যেসব
মূলনীতি দিয়েছে তাহলো: ধোঁকা ও
প্রতারনামুক্ত, মিথ্যার আশ্রয় বিহীন,
পণ্যের দোষ – গুণ স্পষ্ট থাকা, ভাল পণ্যের
সাথে খারাপ পণ্যের মিশ্রণ না করা,
মুনাফাখোরী মানোবৃত্তি পরিহার করে
কল্যাণমুখী মানষিকতা পোষণ, মজুদদারি
চিন্তা-চেতনা পোষণ না করা, ওজনে হের-ফের
না করা, সর্বোপরি যাবতীয় শঠতা ও জুলুম
থেকে বিরত থাকা।
১.২. চাকুরী
এটি জীবিকা নির্বাহে উপার্জনের অন্যতম
মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত। জনসংখ্যার
একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আমাদের দেশে
সরকারী আধা-সরকারী, বেসরকারী, ব্যাংক-
বীমা, এন.জি.ও. ও ব্যক্তিমালিকানাধিন
এবং স্বায়ত্বশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে
চাকুরী করে। এসব চাকুরীর ক্ষেত্রে
ইসলামের মূল দর্শন হলো প্রত্যেক চাকুরে
তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পূর্ণ নিষ্ঠা,
আন্তরিকতা ও সচ্ছতার সাথে পালন করবে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ
বিষয়ের মূলনীতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:
« ﻢﻜﻠﻛ ﻢﻜﻠﻛﻭ ،ﻉﺍﺭ ﻝﻮﺌﺴﻣ ﻦﻋ ﻪﺘﻴﻋﺭ
»
‘‘তোমাদের প্রত্যেকেই এক একজন
দায়িত্বশীল। তোমাদের প্রত্যেককে নিজ
নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।
’’[15]
তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই সকলকে যাবতীয়
অনিয়ম, দুর্নীতি যেমন ঘুষ গ্রহণ,
স্বজনপ্রীতি অন্যায়ভাবে কাউকে সুযোগ
সুবিধা (undue Facilities) দান, কারো প্রতি
জুলুম করা প্রভৃতি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি
রাখতে হবে। কেননা এসব অনিয়ম ও
দুর্নীতি-পরায়ণদের অশুভ পরিণতি সম্পর্কে
ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।[16]
এছাড়াও কর্তব্যে অবহেলা, অনিয়মানুবর্তিতা
ও কার্যে উদাসীনতার দরুন চাকুরীজীবিদের
উপার্জন অনেক সময় বৈধতা হারিয়ে ফেলে।
আমাদের দেশে দেখা যায় অনেক স্কুল-কলেজের
শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে পাঠ দানের পরিবর্তে
টিউশনী ও কোচিং সেন্টারের প্রতি বেশী
ঝুকে পড়েছেন। অনেক ডাক্তার হাসপাতালে
রোগী না দেখে ক্লিনিকে জমজমাট ব্যবসা
শুরু করে দিয়েছেন। যা কর্তব্যে অবহেলার
নামান্তর। তারা যদি স্বীয় দায়িত্ব যথাযথ
ও পূর্ণভাবে পালন করার পর অতিরিক্ত সময়
এসব কাজ করেন তবে তা দোষের নয়।
১.৩.কৃষিকর্ম
কৃষিকর্ম জীবিকা নির্বাহে অন্যতম
উপার্জন মাধ্যম। ইসলাম এটিকে মহৎ পেশা
হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কৃষিকার্যের
সুচনা হয়েছে আদিপিতা আদম আলাইহিস
সালাম থেকেই তাঁকে কৃষি কার্য, আগুনের
ব্যবহার ও কুটির শিল্প শিক্ষা দেয়া
হয়েছিল।[17] পর্যায়ক্রমে এ ব্যবস্থার
উন্নতি সাধিত হয়েছে। পবিত্র কুরআনে
মহান আল্লাহ মানবজাতির কল্যাণে এ
ব্যবস্থাকে সাব্যস্ত করেছেন।[18]
বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। এদেশের
অধিকাংশ লোকই কৃষি নির্ভর জীবিকা
নির্বাহ করে। অথচ ইসলামের কৃষিনীতি
সম্পর্কে অবগত হয়ে যদি কেউ তাঁর এ
ব্যবস্থাপনায় ইসলামী নীতি অনুসরণ করে
তবেই তা হালাল উপার্জন হবে। আর সেগুলো
হলো:
ক. ভূমির মালিক নিজেই চাষ করবে। এ
সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেন:
« ﻦﻣ ﺖﻧﺎﻛ ﻪﻟ ،ﺽﺭﺃ ﺎﻬﻋﺭﺰﻴﻠﻓ »
‘‘যার জমি রয়েছে সে নিজেই চাষাবাদ করবে।
’’[19] তবে এক্ষেত্রে কারো জমি অন্যায়ভাবে
অধিকারে আনে কিংবা উত্তরাধিকারকে অংশ না
দিয়ে চাষ করলে গুরুতর অপরাধ হিসেবে
বিবেচিত হবে।[20]
অথবা, মজুরের দ্বারা নিজের তত্বাবধানে চাষ
করবে অথবা কোন ভূমিহীনকে চাষাবাদ ও
ভোগদখল করতে দিবে।
খ. উৎপন্ন ফসলের নির্দিষ্ট অংশ দেয়ার
শর্তে কাউকে চাষ করতে দেয়া।
গ. প্রচলিত বাজার দর অনুযায়ী নির্দিষ্ট
পরিমাণ নগদ টাকার বিনিময়ে কাউকে এক
বছরের জন্য তার ভোগাধিকার দান করা।[21]
ঘ. জমিতে হারাম দ্রব্য উৎপাদন না করা,
যাতে ক্ষতিকর কোন উপাদান রয়েছে্ যেমন:
আফিম, গাঁজা, চারস বা অনুরূপ মাদক দ্রব্য।
[22]
ঙ. অংশীদারিত্ব চাষাবাদ যাবতীয় প্রতারণা,
ধোঁকা, ঠকবাজি, ও অজ্ঞতা থেকে মুক্ত থেকে
ন্যায়পরায়নতা ও ইনসাফ ভিত্তিক নীতির
লালন করতে হবে।
আল্লামা মাওয়ারদী উল্লেখ করেছেন যে,
উৎপাদনের মূল উপাদান দু’টি, এক. কৃষি, দুই.
ব্যবসা-বানিজ্য। তবে এদুয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও
পবিত্রতম হলো কৃষি।[23]
ইসলামে মানুষের অর্থ-সম্পদ লাভের তিনটি
নৈতিক পন্থা নির্ধারন করে দেয়া হয়েছে।
আর তা হলো:
১. পরিশ্রম:
পরিশ্রমের মাধ্যমে মানুষ অর্থ সম্পদ
উপার্জন করতে পারে। সে সঙ্গে মেধা ও
যোগ্যতার সমন্বয়ে মানুষ অর্থের পাহাড়
গড়তে সক্ষম হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন আল্লাহর
নিকট ঐ জীবিকাই উত্তম যা মানুষ নিজ
হাতে উপার্জন করে। এভাবে শ্রমদানের
ক্ষেত্রও বহুবিধ ও বিচিত্র ধরনের।
তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
১. শিল্পকর্ম:
ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি শিল্পকর্মও
মানুষের অন্যতম পেশা। এ মহতি পেশায়
জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ
নিয়োজিত রয়েছে। এ কর্মটি সম্পর্কে
ইসলাম যথেষ্ট গুরুত্বরোপ করেছে। যুগে যুগে
প্রেরিত নবী-রাসূলগণ শুধু উৎসাহের বানী
প্রদান করেই ক্ষান্ত হননি; বরং শিল্প ও
ব্যবসার ময়দানে তাদের বিশাল অবদান
রয়েছে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:
﴿ ُﻪَٰﻨۡﻤَّﻠَﻋَﻭ َﺔَﻌۡﻨَﺻ ٖﺱﻮُﺒَﻟ ﻢُﻜَﻨِﺼۡﺤُﺘِﻟ ۡﻢُﻜَّﻟ
ۖۡﻢُﻜِﺳۡﺄَﺑ ۢﻦِّﻣ ۡﻞَﻬَﻓ ۡﻢُﺘﻧَﺃ َﻥﻭُﺮِﻜَٰﺷ
﴾٨٠ ‏[ 80 :ﺀﺎﻴﺒﻧﻷﺍ ]
‘‘আমি তাঁকে (দাউদ আলাইহিস সালাম) বর্ম
নির্মাণ শিক্ষা দিয়েছিলাম যাতে তা যুদ্ধে
তোমাদেরকে রক্ষা করে।’’[24]
শিল্প শিক্ষাকে মহান আল্লাহ নিয়ামত
হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং এ-জন্য
শুকরিয়া আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহর নবীগণ কোন না কোন শিল্পকর্মে
নিয়োজিত ছিলেন। উপরোক্ত আয়াতে দাউদ
আলাইহিস সালাম বর্ম শিল্পে নিয়োজিত
ছিলেন বলে আভাস রয়েছে। এছাড়াও তিনি
প্রথম জীবনে চাষী হিসেবে কাজ করেছেন।
তিনি শষ্য বপন ও কর্তন করতেন। মহানবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
‘‘যে জমি মানুষের খিদমতের জন্য কোন কাজ
করে তাঁর দৃষ্টান্ত মূসা আলাইহিস সালাম
জননীর ন্যায়। তিনি নিজে সন্তানকে দুধ
পান করিয়েছেন; আবার ফেরাউনের কাছ থেকে
পাবিশ্রমিক পেয়েছেন। এছাড়া মূসা
আলাইহিস সালাম মাদইয়ানে ৮ বছর চাকরী
করছেন, নূহ আলাইহিস সালাম জাহাজ
নির্মান করেছেন। যাকারিয়া আলাইহিস
সালাম কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন।
বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বাল্যকালে ছাগল চরাতেন, যৌবনে ব্যবসা
করেছেন, চাকরী করেছেন, খন্দকের যুদ্ধে
মাটি কেটেছেন, মাথায় বোঝা বহন করেছেন।
কূপ থেকে পানি তুলেছেন, নিজ হাতে জামা ও
জুতা সেলাই করেছেন, স্ত্রীকে ঘরে রান্নার
কাজে সাহায্য করেছেন, এমনকি দুধ দোহনও
করেছেন। এজন্য পেশা ক্ষুদ্র হোক, বৃহৎ
হোক, তাতে কিছু আসে যায় না। নিজে
পরিশ্রম করে শ্রমলব্দ আয়ে নিজের
পরিবারবর্গের আস্বাদনের জন্য সংগ্রাম করা
অতিশয় সম্মান ও পূণ্যের কাজ।
২. উত্তরাধিকার:
উত্তরাধিকারসূত্রে মানুষ অর্থ সম্পদ লাভ
করে থাকে। কোন ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার
উত্তরাধিগণ ইসলামের বিধান অনুযায়ী
মৃতের পরিত্যক্ত স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি
হতে যে সম্পদ লাব করে থাকে তা হালাল।
৩. হেবা বা দান:
কোন বিনিময় মূল্য বা প্রতিদান ব্যাতিরেকে
কাউকে নিজের সম্পদের মালিকানা হস্তান্তর
বা দান করা এবং যার অনুকুলে হস্তান্তর বা
দান করা হয় সে ব্যাক্তি কর্তৃক তা গ্রহণ
করাকে হেবা বলা হয়। হেবার মাধ্যমে অর্জিত
অর্থ সম্পদ হালাল।
উপার্জন বৈধ হওয়ার ইসলামী মূলনীতি
ইসলামে উপার্জনের ক্ষেত্রে অনুসরণীয় দু’টি
মূলনীতি রয়েছে।
এক. মূলগত: যা উপার্জন করা হবে তা
মূলগতভাবে হালাল হতে হবে।
দুই. পদ্ধতিগত: যা উপার্জন করব তা বৈধ
পন্থায় হতে হবে।
এক. মূলগত:
একজন ব্যক্তি যা উপার্জন করবে সে
উপার্জেয় বস্ত্তটি অবশ্যই উত্তম ও হালাল
হতে হবে। আর ইসলাম যাবতীয় কল্যাণকর ও
হিতকর বস্ত্তকে মানবজাতির জন্য হালাল
করেছে।
সেলক্ষ্যেই পবিত্র কুরআনে ﺕﺎﺒﻴﻃ ও ﻝﻼﺣ
শব্দের অবতারনা হয়েছে। মহান আল্লাহ মানব
জাতিকে সম্বোধন করে হালাল ও তাইয়্যিব যা
রয়েছে তা থেকে আহার করতে বলেছেন। তিনি
বলেন:
﴿ ﺎَﻬُّﻳَﺄَٰٓﻳ ُﺱﺎَّﻨﻟﭐ ْﺍﻮُﻠُﻛ ﺎَّﻤِﻣ ِﺽۡﺭَﺄۡﻟﭐ ﻲِﻓ
ﺎٗﻠَٰﻠَﺣ ﺎٗﺒِّﻴَﻃ ﺎَﻟَﻭ ِﺕَٰﻮُﻄُﺧ ْﺍﻮُﻌِﺒَّﺘَﺗ
ِۚﻦَٰﻄۡﻴَّﺸﻟﭐ ۥُﻪَّﻧِﺇ ۡﻢُﻜَﻟ ّٞﻭُﺪَﻋ ٌﻦﻴِﺒُّﻣ
﴾‏[ 168:ﺓﺮﻘﺒﻟﺍ ]
‘‘হে মানুষ! পৃথিবীতে হালাল ও তাইয়্যেব যা
রয়েছে তা থেকে আহার কর। আর শয়তানের
পদাংক অনুসরণ করো না, নি:সন্দেহে সে
তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।[25]
উপরোক্ত আয়াতের আলোকে বলা যায় যে,
শুধুমাত্র হালাল হলেই চলবে না; বরং তা
অবশ্যই তাইয়্যিব (পবিত্র ও উত্তম) হতে
হবে। এখানে তাইয়্যিব বলতে ভেজালমূক্ত
স্বাস্থসম্মত উদ্দেশ্য। অর্থাৎ এমন উপায়
অবলম্বন করতে হবে যা মূলগত ভাবেই
নির্ভেজাল, খাটি ও পবিত্র। অবশ্য
অধিকাংশ মুফাস্সিরগণ আয়াতে হালাল শব্দ
দ্বারা মূলগত বৈধতার এবং তাইয়্যিব দ্বারা
পদ্ধতিগত বৈধতার অর্থ গ্রহণ করেছেন এবং
এ দু’শব্দ দিয়ে দু’টি মূলনীতির প্রতি
ইঙ্গিত করেছেন।
দুই. পদ্ধতিগত
উপার্জনের ক্ষেত্রে গ্রহণীয় উপায় ও
মাধ্যমটি অবশ্যই বৈধ পন্থায় হতে হবে।
কেননা যাবতীয় অবৈধ উপায় ও পন্থায়
অর্থসম্পদ উপার্জন করতে ইসলাম নিষেধ
রয়েছে। পবিত্র কুরআনের একাধিক আয়াতের
মাধ্যমে এ বিষয়ে মুমিনগণকে সর্তক করা
হয়েছে।
মহান আল্লাহ বলেন:
ٓ﴿ ﺎَﻬُّﻳَﺄَٰٓﻳ ْﺍﻮُﻨَﻣﺍَﺀ َﻦﻳِﺬَّﻟﭐ ﺎَﻟ ْﺍٓﻮُﻠُﻛۡﺄَﺗ
ﻢُﻜَﻟَٰﻮۡﻣَﺃ ِﻞِﻄَٰﺒۡﻟﭑِﺑ ﻢُﻜَﻨۡﻴَﺑ ﺂَّﻟِﺇ ﻥَﺃ َﻥﻮُﻜَﺗ
ًﺓَﺮَٰﺠِﺗ ٖﺽﺍَﺮَﺗ ﻦَﻋ ۚۡﻢُﻜﻨِّﻣ ﺎَﻟَﻭ ْﺍٓﻮُﻠُﺘۡﻘَﺗ
ۚۡﻢُﻜَﺴُﻔﻧَﺃ َّﻥِﺇ َﻪَّﻠﻟﭐ َﻥﺎَﻛ ۡﻢُﻜِﺑ ﺎٗﻤﻴِﺣَﺭ ٢٩
ۡﻞَﻌۡﻔَﻳ ﻦَﻣَﻭ َﻚِﻟَٰﺫ ﺎٗﻧَٰﻭۡﺪُﻋ َﻑۡﻮَﺴَﻓ ﺎٗﻤۡﻠُﻇَﻭ
ِﻪﻴِﻠۡﺼُﻧ ۚﺍٗﺭﺎَﻧ َﻥﺎَﻛَﻭ َﻚِﻟَٰﺫ ﻰَﻠَﻋ ِﻪَّﻠﻟﭐ
ﺍًﺮﻴِﺴَﻳ﴾
‘‘হে মুমিনগণ! তোমরা একে অপরের সম্পত্তি
অন্যায়ভাবে গ্রাস করোনা। কিন্তু তোমাদের
পরস্পর রাযি হয়ে ব্যবসা করা বৈধ; এবং একে
অপরকে হত্যা করিওনা; নিশ্চয়ই আল্লাহ
তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু। আর যে কেউ
সীমালংঘন করে অন্যায়ভাবে তা করবে, তাকে
আমি অগ্নিতে দগ্ধ করব, আর এটা করা
আল্লাহর পক্ষে সহজ।’’[26]
মহান আল্লাহ বলেন:
﴿ ﻢُﻜَﻟَٰﻮۡﻣَﺃ ْﺍٓﻮُﻠُﻛۡﺄَﺗ ﺎَﻟَﻭ ﻢُﻜَﻨۡﻴَﺑ
ْﺍﻮُﻟۡﺪُﺗَﻭ ِﻞِﻄَٰﺒۡﻟﭑِﺑ ﺂَﻬِﺑ ﻰَﻟِﺇ ِﻡﺎَّﻜُﺤۡﻟﭐ
ﺎٗﻘﻳِﺮَﻓ ْﺍﻮُﻠُﻛۡﺄَﺘِﻟ ِﻝَٰﻮۡﻣَﺃ ۡﻦِّﻣ ِﺱﺎَّﻨﻟﭐ
ۡﻢُﺘﻧَﺃَﻭ ِﻢۡﺛِﺈۡﻟﭑِﺑ َﻥﻮُﻤَﻠۡﻌَﺗ ﴾ ‏[ 29:ﺀﺎﺴﻨﻟﺍ ]
‘‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অপরের সম্পদ
অবৈধ পন্থায় গ্রাস করো না এবং মানুষের
ধন-সম্পত্তির কিয়দাংশ জেনে শুনে
অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তা
বিচারকগণের নিকট পেশ করো না।[27]’’
উপরোক্ত আয়াতদ্বয় দ্বারা সুষ্পষ্টভাবে
প্রতিভাত হয় যে, উপার্জনের পদ্ধতি ও
পন্থা অবশ্যই বৈধ হতে হবে। অন্যথায় কঠোর
শাস্তির ঘোষনা রয়েছে। আর এ ধরনের উপায়
জুলমের নামান্তর। যার পরিণতি খুবই
ভয়াবহ। অতএব প্রত্যেক মুসলমানের একান্ত
উচিত উপার্জনের ক্ষেত্রে উপর্যুক্ত দু’টি
বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করা।
প্রখ্যাত আধুনিক তাফসিরকার আল্লামা
রশিদ রেজা আয়াতে উল্লেখিত হালাল ও
তাইয়্যিবা এ দু’টি শব্দের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে
বলেন, কোন বস্ত্ত তাইয়্যিব বা উত্তম
হওয়ার অর্থ হলো তাতে অন্যের অধিকার
সম্পৃক্ত না থাকা। কেননা পবিত্র কুরআনে
যেসব বস্ত্তর ব্যাপারে হারাম শব্দ ব্যবহার
করা হয়েছে। সেগুলো মূলগতভাবেই হারাম বা
নিষিদ্ধ। একমাত্র নিরূপায় অবস্থা ছাড়া
কোন অবস্থাতেই তার ব্যবহার বৈধ নয়। এ
ছাড়াও এক ধরনের হারাম রয়েছে যা
মূলগতভাবে হারাম নয় কিন্তু সংশ্লিষ্ট কোন
কারণে তাকে হারাম বলা হয়েছে। মূলত: এ
জাতীয় বস্ত্তর বিপরীতেই তাইয়্যিব বা
উত্তম শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। সুতরাং
যেসব বস্ত্ত অন্যায়ভাবে উপার্জন করা
হয়েছে, ন্যায়ানুগ পন্থায় করা হয়নি। যেমন:
সুদ, ঘুষ, জুয়া, চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি,
ধোঁকা-প্রতারনা, আমানতের খিয়নত ইত্যাদি
পন্থায় করা হয়েছে এগুলো হারাম। অর্থ্যাৎ
এগুলো তাইয়্যিব বা উত্তম নয়। সারকথা
প্রতিটি অপবিত্র বস্ত্তই হারাম, তা মূলগত
কারণেই হোক কিংবা সংশ্লিষ্ট অন্য কোন
কারণেই হোক।
হালাল উপার্জনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য:
জীবিকা নির্বাহের জন্য উপার্জনের গুরুত্ব
ইসলামে যেমনি রয়েছে, ঠিক তেমনি হালাল
উপার্জনের গুরুত্ব ও অত্যাধিক। ইসলাম
মানুষের জন্য যাবতীয় জীবনোপকরণকে
সহজসাধ্য, সুস্পষ্ট, ও পবিত্র করার
নিমিত্বে সঠিক ও বৈজ্ঞানিক নির্দেশনা
দিয়েছে। অতএব নির্দেশনা বহির্ভূত
যাবতীয় উপার্জনই হারাম বা অবৈধ হিসেবে
বিবেচিত। ইসলামের বক্তব্য হল মানুষকে
নিজের সার্মথ্য ও যোগ্যতানুযায়ী নিজেই
নিজের প্রয়োজনীয় অর্থ ও দ্রব্য সামগ্রীর
সন্ধান করবে। এটি মানুষের অন্যতম
অধিকার। তবে ইসলাম মানুষকে এ অধিকার
দেয়নি যে, সে অর্থ সম্পদ উপার্জনের জন্য
স্বীয় খেয়ালখুশিমত যে কোন পন্থা অবলম্বন
করতে পারবে। তাইতো ইসলাম অর্থসম্পদ
উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল-হারামের পার্থক্য
সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। সমাজ রাষ্ট্র ও
ব্যাক্তির জন্য কল্যানকর যাবতীয়
ব্যবস্থাকে ইসলাম হালাল করেছে। নিম্নে এ
ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করা
হল:
এক. হালাল উপার্জন একটি অলঙ্ঘনীয়
বিধান
ইসলাম মানুষের জন্য হালাল ও হারামের
মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য নিরূপন করেই শেষ
করেনি, বরং হালাল উপার্জনে রয়েছে এর
সুস্পষ্ট নির্দেশনা। ফরজ ইবাদত সমূহের
আদায়ের পর এ মহতি কর্মে ঝাপিয়ে পরতে
উৎসাহিত করা হয়েছে। উপার্জনের ক্ষেত্রে
হালাল ও বৈধ উপায় অবলম্বন করা
ব্যবসায়ীসহ সকল মানুষের উপর ইসলামের
একটি অলঙ্ঘনীয় বিধান। যারা উপার্জনের
ক্ষেত্রে হালাল ও হারামের প্রশ্নে সতর্কতা
অবলম্বন করে না তাদের ব্যপারে নবী করিম
সতর্কবাণী করেছেন। তিনি বলেন:
« ﻲﺗﺄﻳ ﻰﻠﻋ ﺱﺎﻨﻟﺍ ،ﻥﺎﻣﺯ ﻻ ﻲﻟﺎﺒﻳ
ﺀﺮﻤﻟﺍ ﺎﻣ ﺬﺧﺃ ،ﻪﻨﻣ ﻝﻼﺤﻟﺍ ﻦﻣﺃ ﻡﺃ
ﻦﻣ ﻡﺍﺮﺤﻟﺍ »
‘‘মানুষের নিকট এমন একটি সময় আসবে,
যখন ব্যক্তি কোন উৎস থেকে সম্পদ আহরন
করছে, তা হালাল না হারাম, সেদিকে কোন
ভ্রুক্ষেপ করবে না।’’[28]
দুই. হালাল উপার্জন দু’আ কবুলের
পূর্বশর্ত
মানুষের প্রত্যহিক ও জাগতিক জীবনের
চাহিদার কোন অন্ত নেই। তবে এগুলো
মানুষের কাঙ্খিত ও বাঞ্চিত হলেও
বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মহান স্রষ্ট্রার
অনুগ্রহের, ভূমিকাই সবচেয়ে বেশী। আর এর
জন্য প্রয়োজন একান্তে তাঁর দরবানে আরাধনা
করা। মহান আল্লাহ ও মানুষে এ ব্যপারে সাড়া
দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। শুধু তাই নয়,
এটি অন্যতম ইবাদত ও বটে। রাসূল সা. বলেন
:[29]
« ﺀﺎﻋﺪﻟﺍ ﺓﺩﺎﺒﻌﻟﺍ ﻮﻫ »
‘‘দোয়া হচ্ছে ইবাদত’’
অতএব দু’আ ইসলামে অন্যতম একটি ইবাদতে
পরিণত হয়েছে, যার মাধ্যমে বান্দার সাথে
আল্লাহর গভীর প্রেম নিবেদন করা চলে এবং
যাবতীয় প্রয়োজন পূনণে সহায়ক হয়। এ
গুরুত্বপূর্ণ কর্মটি আল্লাহর দরবারে গৃহীত
হতে হলে উপার্জন অবশ্যই হালাল হতে হবে।
কেননা আল্লাহ পবিত্র। তিনি পবিত্র ছাড়া
কোন কিছুই গ্রহণ করেননা, অতএব অবৈধ
উপার্জন যারা করে তাদের খাদ্যের উপার্জন
হয় অবৈধ অর্থে হওয়ায় ইসলম যাবতীয় রক্ত
মাংশ সবই হারাম দ্বারা পুষ্ট হয়। ফলে এ
ধরনের ব্যক্তির প্রার্থনাকে ইসলামে কখনো
সমর্থন করেনা। এ মর্মে রাসূল সা. বলেন:
« َّﻥِﺇ َﻪﻠﻟﺍ ٌﺐِّﻴَﻃ ﺎَﻟ ُﻞَﺒْﻘَﻳ ،ﺎًﺒِّﻴَﻃ ﺎَّﻟِﺇ
َﻪﻠﻟﺍ َّﻥِﺇَﻭ َﺮَﻣَﺃ َﻦﻴِﻨِﻣْﺆُﻤْﻟﺍ ﺎَﻤِﺑ َﺮَﻣَﺃ ِﻪِﺑ
،َﻦﻴِﻠَﺳْﺮُﻤْﻟﺍ :َﻝﺎَﻘَﻓ ﺎَﻳ} ُﻞُﺳُّﺮﻟﺍ ﺎَﻬُّﻳَﺃ
ﺍﻮُﻠُﻛ ﺍﻮُﻠَﻤْﻋﺍَﻭ ِﺕﺎَﺒِّﻴَّﻄﻟﺍ َﻦِﻣ ،ﺎًﺤِﻟﺎَﺻ
ﻲِّﻧِﺇ َﻥﻮُﻠَﻤْﻌَﺗ ﺎَﻤِﺑ {ٌﻢﻴِﻠَﻋ ‏[ :ﻥﻮﻨﻣﺆﻤﻟﺍ
51 ‏] :َﻝﺎَﻗَﻭ ﺎَﻳ} ﺎَﻬُّﻳَﺃ ﺍﻮُﻨَﻣﺁ َﻦﻳِﺬَّﻟﺍ
ﺍﻮُﻠُﻛ ِﺕﺎَﺒِّﻴَﻃ ْﻦِﻣ ﺎَﻣ {ْﻢُﻛﺎَﻨْﻗَﺯَﺭ
‏[ :ﺓﺮﻘﺒﻟﺍ 172 ‏] َّﻢُﺛ َﺮَﻛَﺫ َﻞُﺟَّﺮﻟﺍ ُﻞﻴِﻄُﻳ
َﺮَﻔَّﺴﻟﺍ َﺚَﻌْﺷَﺃ ،َﺮَﺒْﻏَﺃ ُّﺪُﻤَﻳ ِﻪْﻳَﺪَﻳ ﻰَﻟِﺇ
،ِﺀﺎَﻤَّﺴﻟﺍ ﺎَﻳ ،ِّﺏَﺭ ﺎَﻳ ،ِّﺏَﺭ ُﻪُﻤَﻌْﻄَﻣَﻭ
ُﻪُﺑَﺮْﺸَﻣَﻭ ،ٌﻡﺍَﺮَﺣ ُﻪُﺴَﺒْﻠَﻣَﻭ ،ٌﻡﺍَﺮَﺣ ،ٌﻡﺍَﺮَﺣ
َﻱِﺬُﻏَﻭ ،ِﻡﺍَﺮَﺤْﻟﺎِﺑ ُﺏﺎَﺠَﺘْﺴُﻳ ﻰَّﻧَﺄَﻓ
؟َﻚِﻟَﺬِﻟ»
‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআল পবিত্র। তিনি শুধু
পবিত্র বস্ত্তই গ্রহণ করেন। তিনি
মুমিনদের সেই আদেশই দিয়েছেন, যে আদেশ
তিনি দিয়েছিলেন রাসূলগণের।’’ আল্লাহ
তা’আলা বলেন : ‘‘হে ইমানদারগণ! তোমরা
পবিত্র বস্ত্ত-সামগ্রী আহার কর, যেগুলো
আমি তোমাদেরকে রুযী হিসেবে দান করেছি।’’
অতঃপর রাসূল সা. এমন এক ব্যক্তির কথা
উল্লেখ করলেন, যে দীর্ঘ সফরে থাকা
অবস্থায় এলোমেলো চুল ও ধূলি-ধুসরিত
ক্লান্ত-শ্রান্ত বদনে আকাশের দিকে আল্লাহর
দরবারে হাত তুলে প্রার্থনা করে ডাকছেঃ হে
আমার প্রভূ! হে আমার প্রভূ! অথচ সে যা খায়
তা হারাম, যা পান করে তা হারাম, যা পরিধান
করে তা হারাম এবং হারামের দ্বারা সে পুষ্টি
অর্জন করে। তার প্রার্থনা কিভাবে কবুল হবে
?’’[30]
ইবন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে
এসেছেঃ
« ﺖﻴﻠﺗ ﻩﺬﻫ ﺔﻳﻻﺍ ﺪﻨﻋ ﻝﻮﺳﺭ ﻪﻠﻟﺍ ﺹ ﴿
ﺎﻳ ﺱﺎﻨﻟﺍ ﺎﻬﻳﺃ ﺍﻮﻠﻛ ﺎﻤﻣ ﻲﻓ ﺽﺭﻷﺍ
ﻡﺎﻘﻓ ﴾ﺎﺒﻴﻃ ﻼﻠﺣ ﺪﻌﺳ ﻦﺑ ﺹﺎﻗﻭ ﻰﺑﺃ ،
ﻝﺎﻘﻓ : ﺎﻳ ﻝﻮﺳﺭ ﻪﻠﻟﺍ ﻰﻠﺻ ﻪﻠﻟﺍ ﻪﻴﻠﻋ
،ﻢﻠﺳﻭ ﻪﻠﻟﺍ ﻉﺩﺍ ﺏﺎﺠﺘﺴﻣ ﻲﻨﻠﻌﺠﻳ ﻥﺃ
ﺓﻮﻋﺪﻟﺍ ، ﻝﺎﻘﻓ ﻪﻟ ﻲﺒﻨﻟﺍ ﻰﻠﺻ ﻪﻠﻟﺍ
ﻪﻴﻠﻋ ﻢﻠﺳﻭ : ﺎﻳ ﺪﻌﺳ ﺐﻃﺃ ﻚﻤﻌﻄﻣ ﻦﻜﺗ
ﺏﺎﺠﺘﺴﻣ ﺓﻮﻋﺪﻟﺍ …»
‘‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর
নিকট একদা এ আয়াতটি তেলাওয়াত করা হল।
‘‘হে মানবমন্ডলী ! পৃথিরীর হালাল ও
পবিত্র বস্ত্ত-সামগ্রী ভক্ষন কর।’’ তখন
সাদ ইবন আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু
দাঁড়িয়ে বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আল্লহর
কাছে দু’আ করুন যেন আমার দু’আ কবুল হয়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বললেনঃ হে সা‘দ, তোমার পানাহারকে হালাল
কর, তবে তোমার দু’আ কবুল হবে।’’[31]
তিন. হালাল উপার্জনে বরকত লাভ হয়
উপার্জনে বরকত লাভ করতে হষে একমাত্র
হালাল পন্থায় হতে হবে। কেননা বরকত দানের
মালিক মহান আল্লাহ। তিনি শুধু বৈধ
উপার্জনেকেই বরকত মন্ডিত করেন। এবং
যাবতীয় অবৈধ উপার্জনের বারকত নষ্ট করে
দেন। আর যেখানে অপচয় বৃদ্ধি পায়। ফলে
সম্পদের প্রাচুর্যতা লাভে বিলম্ব হয়।
অন্যদিকে হালাল উপার্জন কম হলেও তাতে
বরকতের কারণে খুব স্বল্প সময়েই বৃদ্ধি
পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
চার. হালাল উপার্জন জান্নাত লাভের
একমাত্র উপায়
মানুষের দু’টি জীবন রয়েছে, একটি
ইহলৌকিক, অপরটি পরলৌকিক। অতএব
হালাল পন্থায় উপার্জনকারী পরকালে
জান্নাতে যাবে। আর অবৈধ পন্থায়
উপার্জনকারী ব্যাক্তি দুনিয়ার জীবনে
সম্পদের পাহাড় গড়লেও পরকালীন জীবনে
তার জন্য ভয়াবহ আযাব ও শাস্তি অপেক্ষা
করছে।
পাঁচ. অবৈধ উপায়ে সম্পদ
উপার্জনকারীর জন্য জাহান্নাম
অবধারিত
ইবন আববাস রা.বর্ণিত হাদীসে রাসূল সা.
বলেছেনঃ
« ﻞﻛ ﺪﺴﺟ ﺖﺒﻧ ﻦﻣ ﺭﺎﻨﻟﺎﻓ ﺖﺤﺳ ﻰﻟﻭﺃ
ﻪﺑ »
‘‘আর যে দেহ হারাম খাদ্য দ্বারা গড়ে উঠে তার
জন্য দোযখের আগুনই উত্তম।’’[32]
কাব ইবন উজরাহ রা. রাসূলে কারীম সা. থেকে
বর্ণনা করেন:
« ﺎَﻟ ُﻞُﺧْﺪَﻳ َﺔَّﻨَﺠْﻟﺍ ٌﺪَﺴَﺟ ٍﻡﺍَﺮَﺤِﺑ َﻱِّﺬُﻏ »
‘‘যে শরীর হারাম পেয়ে হ্রষ্ট পুষ্ট হয়েছে,
তা জান্নাতে যাবে না।’’[33]
দুনিয়ার জীবনের কৃতকর্মের উপর ভিত্তি
করে মহান আল্লাহ মানুষের জন্য পুরুস্কার ও
শাস্তি উভয়ের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। যারা
তাঁর অনুগত বান্দা তারাই পুরুস্কার প্রাপ্ত
হবে। যেহেতু অবৈধ উপায়ে উপার্জনকারী
ব্যক্তি তার অবাধ্য ও দুশমন তাই তাদের জন্য
ও শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে। অতএব এ
পন্থা অবলম্বনকারী ব্যক্তি জাহান্নামী।
ছয়. হালাল উপার্জন ইবাদত কবুলের শর্ত
অর্থ-সম্পদ দ্বারাই মানুষ জীবিকা নির্বাহ
করে, খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করে তার দেহের বৃদ্ধি
ঘটে এবং সুস্বাস্থ্য লাভ হয়। কিন্তু এ
উপকরণ ক্রয়ের অর্থ যদি অবৈধ উপায়ে
উপার্জিত হয় তবে তা কিভাবে বৈধ
শারিরিক বৃদ্ধি হতে পারে। ফলে তার
শরীরের রক্তে ও মাংসে অবৈধ বিষয়ের
সংমিশ্রন ঘটে। আর এর দ্বারা যত ইবাদতই
করা হোক না তা গ্রহনযোগ্য হতে পারে না।
কেননা আল্লাহ অপবিত্র কোন কিছুই গ্রহণ
করে না। অতএব হালাল উপার্জন ইবাদত
কবুলের পূর্ব শর্ত হিসেবে শিরোধার্য।
সালাত, যাকাত ও হজ্জ ইত্যাদি ফরয
ইবাদতসমূহ কবুল হওয়ার জন্র অবশ্যই বৈধ
পন্থায় উপার্জন করতে হবে।
খুলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবায়ে কিরাম
ছিলেন হালাল উপার্জনের অন্বেষক
তাঁরা যাবতীয় লেন দেন হালাল পন্থা অবলম্বন
করতেন। হারামের ভয়াবহতা সম্পর্কে তারা
খুবই সচেতন ছিলেন। আবু বকর রা. এর একটি
ঘটনা থেকে তাঁর হারাম বর্জন প্রবণতা ও
হালালের বিষয়ে কঠোরতা সহজেই অনুমেয়।
বর্ণিত আছে যে, আবু বকর রা. এর এক গোলাম
ছিল সে তাঁর সঙ্গে কিছু অর্থের বিনিময়ে
মুক্তির চুক্তি পত্র করে। অতঃপর সে যখন
প্রতিদিন মুক্তিতপনের কিছু অর্থ নিয়ে
আসতো, তখন আবু বকর রা. তাকে জিজ্ঞাসা
করতেন, এ অর্থ কিভাবে সংগ্রহ করেছো?
যদি সে সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারতো,
তবেই তিনি তা গ্রহণ ও ব্যবহার করতেন।
অন্যথায় ব্যবহার করতেন না। এক রাতে সে
আবু বকর রা. এর জন্য কিছু খাবার নিয়ে
এলো। সে দিন তিনি রোযা রেখেছিলেন।
তাই সেই খাবার সম্পর্কে প্রশ্ন করতে ভুরে
যান এবং তা থেকে এক লোকমা খেয়ে ফেলেন।
অতঃপর মনে হওয়া মাত্র তাকে জিজ্ঞেস
করলেন, এ খাবার তুমি কিভাবে অর্জন করেছ?
সে বললোঃ জাহেলিয়াতের আমলে আমি মানুষের
ভাগ্য গণনা করতাম। আমি ভাল গণক ছিলাম
না। তাই মানুষকে শুধু ধোঁকা দিতাম। এই
খাবার সেই ধোঁকার মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ
দিয়ে সংগৃহীত। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু
বললেনঃ সর্বনাশ তুমি আমায় একি করেছ!
অতঃপর তিনি গলায় আঙ্গুল দিয়ে ভমি করার
চেষ্টা করেন, কিন্তু সে খাবারের কিছুই বের
হয়নি। অতঃপর তিনি পানি পান করে
ইচ্ছাকৃত বমির মাধ্যমে পেটের সব খাবার বের
করে দিলেন। তিনি আরো বললেনঃ উক্ত
খাবার বের করতে গিয়ে আমার মৃত্যুর ঝঁকি
থাকত তাহলেও তা বের করে ছাড়তাম। কেননা
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেছেনঃ ‘‘যে শরীর হারাম খাদ্য দিয়ে
স্বাস্থ্য লাভ করে, তার জন্য জাহান্নাম
উপযুক্ত স্থান। তাই আমি ভয় পেয়ে যাই, যে
এক লোকমা হারাম খাবার দিয়ে আমার শরীর
কিভাবে মোটা-তাজা হতে পারে।’’
হালাল উপার্জনের গুরুত্ব সম্পর্কে
উলামায়ে কিরামের বক্তব্য
বৈধ পন্থায় উপার্জনের গুরুত্ব উপলব্দি
করতঃ তার তাৎপর্য ও পরিণাম বর্ণনা করতে
গিয়ে বিদগ্ধ উলামায়ে কিরাম ও
মুফাসসিরগণ পান্ডিত্যপূণ উক্তির অবতারনা
করেছেন। যেমন: সুফিয়ান সাওরি
রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ
ﺎﻨﻛ ﺔﻌﺴﺗ ﻉﺪﻧ ﻝﻼﺤﻟﺍﺭﺎﺸﻋﺃ ﺔﻓﺎﺨﻣ
ﻉﻮﻗﻮﻟﺍ ﻲﻓ ﻡﺍﺮﺤﻟﺍ
‘‘না জানি তা হারামের অন্তর্ভক্ত হয়ে যায় এ
আশংকায় আমরা হালাল সম্পদের দশভাগের
নয়ভাগ পরিহার করতাম।’’
দুই. ইবন আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ
তাওবা করে হালাল উপার্জনে ফিরে না আসা
পর্যন্ত আল্লাহ এমন কোন মানুষের নামায
কবুল করেন না, যার উদরে হারাম খাদ্য
রয়েছে।
তিন. ইমাম ওহাব ইবনুল ওয়ারদ (রহ.)
বলেনঃ যদি তুমি রাত ভর খুটির ন্যায়
ইবাদতে দাড়িয়ে থাক, তবুও তা তোমার কোন
কাজে আসবে না! যতক্ষন পর্যন্ত তুমি নিশ্চত
হবে যে, তুমি যা খাচ্ছ তা হালাল না হারাম।
চার সুফিয়ান সাওরী (রহ.) বলেনঃ যে লোক
অবৈধ অর্থ দিয়ে কোন নেক কাজ করে, সে
পেশাব দিয়ে কাপড় পবিত্র কারীর মত।
উপসংহার:
ইসলাম কল্যাণকর এক মহতি জীবন ব্যবস্থা
এতে যাবতিয় পবিত্র ও উত্তম বিষয় ও
বস্ত্তকে বৈধ করা হয়েছে। কেননা বস্তু
মাত্রের মাঝেই কিছু কল্যাণ ও কিছু
অকল্যাণের সমাহার রয়েছে। গুনাগুণের
বিচারে যে বস্ত্ততে মানুষের জন্য কল্যানকর
উপাদানের পরিমাণ বেশী, অকল্যানের
পরিমাণ কম, সেই গুলোকেই মহান আল্লাহ
মানুষের জন্য হালাল করে দিয়েছেন। আর যে
সকল বস্ত্ততে কল্যান কম অথচ অকল্যানের
পরিমাণ বেশী, সেগুলোকে মনুষের জন্য হারাম
করে দিয়েছেন। (যেমন মদ হারাম হওয়ার
কারণ কুরআনে বিধৃত হয়েছে) অতএব, আমাদেরক
খাওয়া-দাওয়া, পোষাক-আষাক এবং বিভিন্ন
দ্রব্য সামগী্রর ব্যবহার, এমনকি যাবতীয়
আয় উপার্জনের ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যে,
সেগুলো যেন হালাল ও উত্তম হয়। যা মানব
দেহের জন্য ক্ষতিকর ও ধ্বংসাত্নক পদার্থ্য
দিয়ে তৈরী অথবা যা মানুষের মানবতা বোধকে
ধ্বংস করে অথবা যা মানুষের জন্য
পাশবিকতার জন্ম দেয় এবং তার সংযমী
স্বভাবকে বিনষ্ট করে! কিংবা যা মানুষের
আধ্যাতিক ও নৈতিক ক্ষতির (ব্যধি) কারণ
হয়, এসকল বস্ত্ত ও উপার্জন মাধ্যম অবশ্যই
পরিহার করতে হবে। তাছাড়া যেসব উপায়
দম্ভ, অহংকার জন্ম দেয়, পারস্পরিক
ভ্রাতৃত্ববোধকে নষ্ট করে, নিষিদ্ধ ভোগ-
বিলাসের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করে, জুলুম-
স্বেচ্ছাচারিতা ও আত্নকেন্দ্রিকতার জন্ম
দেয়, দুশ্চরিত্রের প্রতিধাবিত করে,
মুসলমানদেরকে অবশ্যই এসব মাধ্যম বর্জন
করতে হবে। আমাদের রুজি-রোজগার যখন এসব
থেকে পূতে পবিত্র হবে তখনই তা হালাল ও
সিদ্ধ হবে।
তথ্যসূত্রঃ
[1] . সূরা আল-বাকারাহ: ২৯।
[2]. সূরা জুমআহ: ১০।
[3]. কুরতুবী, আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ,
আলজামেউ লি আহকামিল কুরআন,
খ.১৮,পৃ.৯৬।
[4] . সূরা জুমআহ: ৯।
[5] . সূরা মুয়যাম্মিল: ২০।
[6] . আবুল দিদা ইসমইল ইবন উমর ইবন
কাসীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম,
সম্পাদনায়: সামী ইবন মুহাম্মদ সাল্লামা,
বৈরুত: দারু তাইবা নিন্ন্যাসরী, দিত্বীয়
সংস্করণ, ১৪২০ হি, খ. ৮, পৃ. ২৫৮।
[7] . ইমাম মুসলিম, সহীহ মুসলিম. হাদীস
নং. (১০৪২)।
[8] . ইমাম বুখারী, আলজামে‘উসসাহীহ,
হাদীস নং ১৪৭৪; ইমাম মুসলিম, সহীহ
মুসলিম. হাদীস নং. ১০৪০।
[9] . ইমাম আহমাদ, মুসনাদ, খ.৪, পৃ. ১৪১.
[10] . ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম পেশা হলো:
অপ্রয়োজনে ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ,
বেশ্যাবৃত্তি, নৃত্য ও যেনৈশিল্প, অবৈধ
ব্যবসা-বানিজ্য যেমন, মুর্তি, অবৈধ পাণীয়,
ভাষ্কর্য ও প্রতিকৃতি নির্মান শিল্প, সুফী
কারবার, ওজনে কম দেয়া, ধোঁকা ও
প্রতারণামূলক ব্যবসা, মিথ্যার আশ্রয় নেয়া,
ও চাকুরী হতে অবৈধ উপার্জন যেমন ঘুষ
গ্রহণ।
[11] . আবূ বকর আহমদ ইবনুল হুসাইন আল-
বায়হাকী, সুনান আল-বায়হাকী, সম্পাদনায়:
আব্দুল কাদির আতা (মক্কা আল-মুকাররমা:
মাকতাবাতু দারুল বায, ১৪১৪ হি/১৯৯৪
খ্রী.) খ. ৬, পৃ. ১২৮। ইমাম বায়হাকী বলেন,
এর রাবী দুর্বল।
[12] . সূরা আল-বাকারা: ২৭৫।
[13] . গাযালী, ইহইয়াউ উলুমুদ্দীন,
(মাকতবাতুল মুস্তফা আল বাবী ওয়াল হালবী)
খ. ২, পৃ. ৬৪। ইমাম ‘ইরাকী বলেন: মুরসাল।
[14] . ইমাম তিরমিযী, জামে’ আত্-
তিরমিযী, হাদীস নং- ১২০৯। তবে আল্লামা
আলবানী এটাকে দুর্বল বলেছেন।
[15] .ইমাম বুখারী, সহীহ, হাদীস নং ৮৯৩ ;
ইমাম মুসলিম, সহীহ, হাদীস নং ১৮২৯।
[16] . ঘুষ গ্রহীতা ও দাতা উভয়ের অশুভ
পরিণতি সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
ُﻝﻮُﺳَﺭ َﻦَﻌَﻟ ِﻪَّﻠﻟﺍ ﻰَّﻠَﺻ ُﻪﻠﻟﺍ ِﻪْﻴَﻠَﻋ َﻢَّﻠَﺳَﻭ
ﻲِﺷﺍَّﺮﻟﺍ ﻲِﺸَﺗْﺮُﻤْﻟﺍَﻭ
‘‘ঘুষ দাতা ও গ্রহীতাকে আল্লাহ্র রাসূল
লা‘নত করেছেন।” [ইমাম তিরমিযী, সুনান
তিরমিযী, হাদীস নং ১৩৩৭; ইমাম আবু
দাউদ, আসসুনান, ৩৫৮০] জুলুম, স্বজনপ্রীতি
সংক্রান্ত হাদীস আসবে।
[17] . ইসলামী বিশ্বকোষ, (ঢাকা: ই. ফা. বা.
তা. বি.) খ. ১, পৃ. ২৪৩; ইবন খালদুন,
মুবাদ্দমা, (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১ম প্রকাশ,
১৯৮১) খ. ২, পৃ. ৭-৮।
[18] . আল্লাহ তা’আলা বলেন:
﴿ ُﻦَٰﺴﻧِﺈۡﻟﭐ ِﺮُﻈﻨَﻴۡﻠَﻓ ٰﻰَﻟِﺇ ٓۦِﻪِﻣﺎَﻌَﻃ ٢٤
ﺎَﻨۡﺒَﺒَﺻ ﺎَّﻧَﺃ َﺀﺂَﻤۡﻟﭐ ﺎّٗﺒَﺻ ٢٥ َّﻢُﺛ ﺎَﻨۡﻘَﻘَﺷ
َﺽۡﺭَﺄۡﻟﭐ ﺎّٗﻘَﺷ ٢٦ ﺎَﻬﻴِﻓ ﺎَﻨۡﺘَﺒۢﻧَﺄَﻓ ﺎّٗﺒَﺣ ٢٧
ﺎٗﺒَﻨِﻋَﻭ ﺎٗﺒۡﻀَﻗَﻭ ﺎٗﻧﻮُﺘۡﻳَﺯَﻭ ٢٨ ﺎٗﻠۡﺨَﻧَﻭ ٢٩
َﻖِﺋﺁَﺪَﺣَﻭ ﺎٗﺒۡﻠُﻏ ٣٠ ﺎّٗﺑَﺃَﻭ ٗﺔَﻬِﻜَٰﻓَﻭ ٣١
ﺎٗﻌَٰﺘَّﻣ ۡﻢُﻜَّﻟ ۡﻢُﻜِﻤَٰﻌۡﻧَﺄِﻟَﻭ ﴾
সূরা আবাসা: ২৪-৩২।)
[19] . ইমাম বুখারী, সহীহ আল বুখারী,
হাদীস নং – ২৩৪০।
[20] . কেউ এক খন্ড জমি অন্যায়ভাবে
অধিকারে নিলে কিয়ামতের দিন ঐ জমির
সাত স্তবক পর্যন্ত তার কাঁধে ঝুলিয়ে দেয়া
হবে। নবী (সা.) বলেছেন, তিন ব্যক্তির উপর
আল্লাহ অভিসম্পাত করেন। তাদের একজন
হলো যে জমির আইল বা সীমানা পরিবর্তন
করে ফেলে। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল, আল-
মুসনাদ (মিসর: মুয়াসসাতুল কুরতবা, তা. বি)
খ. ৪, পৃ. ১০৩।
[21] . মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম,
ইসলামের অর্থনীতি, (ঢাকা: খায়রুন
প্রকাশনী, ৪র্থ সংস্করণ, ১৯৮৭) পৃ.
১৫৮-১৫৯।
[22] . রাসূল (সা.) বলেছেন, মাদক দ্রব্য
উৎপাদনকারী, যে উৎপাদন করার, মদ্যপায়ী,
বহনকারী, যার কাছে বহন কলে নেয়া হয়, যে
পান করায়- পরিবেশনকারী, বিক্রয়কারী,
মূল্য গ্রহণ ও ভক্ষনকারী এবং যার জন্য তা
ক্রয় করা হয় । এ সকলের উপরই অভিশাপ।
(আবূ দাউদ সুলাইমান ইবনুল আণআম আস-
সিজিস্তানী। সুনান, সম্পাদনা: মহিউদ্দীন
আবদুল হামিদ ) বৈরুত দারুল ফিকর, তা.বি)
খ. ৩ পৃ. ২৪৪।
[23] . আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া,
ইসলামী অর্থনীতির আধুনিক রুপায়ন (ঢাকা:
কওমী পাবলিকেশন্স ১ম সংস্করণ ১৪০৮
হি:/ ২০০১ খ্রী:) পৃ. ১৭৯।
[24] . সূরা আল-আম্বিয়া: ৮০।
[25] . সূরা আল-বাকারা: 168।
[26] .সূরা নিসা:২৯।
[27] . সূরা আল-বাকারাহ্: ১৮৮।
[28] . ইমাম বুখারী, আস-সাহীহ, হাদীস নং
২০৫৯।
[29] . আবু দাউদ, সুনান, হাদীস নং ১৪৭৯।
[30] . ইমাম মুসলিম, সহীহ মুসলিম, হাদীস
নং- ১০১৫।
[31] . ইমাম তাবারানী, মু‘জামুল আওসাত, খ.
৬, পৃ. ৩১০
[32] .তাবারানী।
[33]. আবু ইয়া‘লা, মুসনাদ আবী ইয়া‘লা, খ.১
পৃ. ৮৪।
_________________________________________
________________________________________
লেখক: ড. মোঃ আবদুল কাদের
সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
সূত্র: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ,
রিয়াদ, সৌদিআরব

কোন মুসলিম কি নির্দিষ্ট কোন ইমামের কিংবা ব্যক্তির তাক্বলীদ করতে বাধ্য? কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে পর্যালোচনা

image

ইবনু
শিহাব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, সালেম
ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) তাকে (ইবনে
শিহাব) বলেছেন, তিনি [সালেম
ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ)] শামের
একজন লোকের নিকট থেকে শুনেছেন,
তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ)-
কে হজ্জে তামাত্তু সম্পর্কে জিজ্ঞেস
করলে আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ)
বললেন, তা হালাল। তখন সিরীয়
লোকটি বললেন, তোমার পিতা
(ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব) তা নিষেধ
করেছেন। তখন আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর
(রাঃ) বললেন, যে কাজ আমার পিতা
নিষেধ করেছেন সে কাজ যদি
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পালন করেন,
তাহ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর
নির্দেশ অনুসরণযোগ্য, না আমার
বাবার নির্দেশ অনুসরণযোগ্য?
লোকটি বললেন, বরং রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ)-এর নির্দেশ অনুসরণযোগ্য।
তখন আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ)
বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হজ্জে
তামাত্তু আদায় করেছেন।
(তিরমিযী, হা/৮২৪, ‘হজ্জ’
অধ্যায়, ‘হজ্জে তামাত্তু সম্পর্কে যা
এসেছে’ অনুচ্ছেদ, সনদ ছহীহ।) ২য়
শতাব্দী হিজরীর পরে প্রচলিত
তাক্বলীদের আবির্ভাব ঘটে।
অতঃপর ৪র্থ শতাব্দী হিজরীতে
বিভিন্ন ইমামের নামে বিভিন্ন
তাক্বলীদী মাযহাবের প্রচলন হয়।
শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ)
বলেন, ‘জেনে রাখ, চতুর্থ শতাব্দী
হিজরীর আগের লোকেরা নির্দিষ্ট
কোন একজন বিদ্বানের মাযহাবের
মুক্বাল্লিদ তথা অন্ধানুসারী ছিল
না। কোন সমস্যা সৃষ্টি হ’লে
লোকেরা যেকোন আলেমের নিকট
থেকে ফৎওয়া জেনে নিত। এ
ব্যাপারে কারো মাযহাব যাচাই করা
হ’ত না’। (শাহ অলিউল্লাহ,
হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ
১/১৫২-৫৩ ‘চতুর্থ শতাব্দী ও তার
পরের লোকদের অবস্থা বর্ণনা’
অনুচ্ছেদ।) এই উক্তি প্রমাণ করে
যে, মাযহাবের তাক্বলীদ শুরু হয়েছে
৪র্থ শতাব্দী হিজরী হ’তে।
ওলামায়ে কেরাম-যাদের ইজতিহাদ
সর্বত্র গৃহীত হয়েছে, তাঁরা সকলেই
তাক্বলীদের বিরোধিতা করেছেন।
যেমন- ইবনুল কাইয়িম (রহঃ)
বলেন, ‘নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির
তাক্বলীদ দ্বারা ফৎওয়া প্রদান করা
জায়েয নয়। কেননা তাক্বলীদ ইলম
নয়। আর ইলম বিহীন ফৎওয়া
প্রদান করা হারাম। সকলের
ঐক্যমত হ’ল তাক্বলীদের নাম ইলম
নয় এবং মক্বাল্লিদের নাম আলেম
নয়। (ই‘লামুল মুওয়াক্কি‘ঈন,
২/৮৬।) অতএব তাক্বলীদ নয়,
কুরআন ও হাদীছের যথাযথ
অনুসরণই ইসলামের মৌলিক
বিষয়। যেমনটি অনুসরণ করেছেন
সালাফে ছালেহীন। তারা কারো
মুক্বাল্লিদ ছিলেন না,
প্রসিদ্ধ চার ইমামের সাথে তাঁদের
ছাত্রদের অনেক মাসআলায়
মতবিরোধ লক্ষ্য করা যায়।
‘মুখতাছারুত ত্বহাবী’ গ্রন্থে অনেক
মাসআলাতে ইমাম আবু হানীফার মতের
বৈপরীত্য পরিলক্ষিত হয়।
অনুরূপভাবে ‘হেদায়াহ’ গ্রন্থ
প্রণেতা মারগিনানী, ‘বাদায়েয়ুছ
ছানায়ে’ প্রণেতা আল-কাসানী,
‘ফাতহুল ক্বাদীর’ প্রণেতা কামাল
ইবনুল হুমাম প্রমুখ আলেম হানাফী
মাযহাবের বড় বড় বিদ্বান ছিলেন।
কিন্তু তাঁরা ইমাম আবু হানীফার
অন্ধানুসারী ছিলেন না; বরং কুরআন
ও হাদীছ অনুসরণ করতে গিয়ে ইমাম
আবু হানীফার অনেক মতকে তারা
প্রত্যাখ্যান করেছেন। প্রকৃতপক্ষে
তাঁরাই ইমাম আবু হানীফার অনুসারী
ছিলেন। কেননা তিনি বলেন,
ﻲﺒﻫﺬﻣﻮﻬﻔﺜﻳﺪﺤﻟﺎﺤﺻﺍﺫﺇ.
‘যখন ছহীহ হাদীছ পাবে, জেনো
সেটাই আমার মাযহাব’।
অনুরূপভাবে ইবনু কুদামা (রহঃ),
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু
তায়মিয়া (রহঃ), ইবনুল ক্বাইয়িম
(রহঃ), ইবনু রজব (রহঃ) হাম্বলী
মাযহাবের খ্যাতনামা বিদ্বান
ছিলেন। আবু ইসহাক আশ-শীরাযী
(রহঃ), ইমাম নববী (রহঃ) শাফেঈ
মাযহাবের এবং ইবনু আব্দিল বার্র
(রহঃ), ইবনু রুশদ (রহঃ), ইমাম
শাত্বেবী (রহঃ) মালেকী মাযহাবের
বিদ্বান ছিলেন। তাঁদের কেউ কোন
নির্দিষ্ট মাযহাবের অন্ধানুসারী
ছিলেন না। বরং তাঁরা কুরআন ও
ছহীহ হাদীছের অনুসরণ করতে
গিয়ে তাঁদের ইমামদের বিরুদ্ধে মত
পোষণ করতে সামান্যতম দ্বিধাবোধ
করেননি।

তাক্বলীদ কার জন্য বৈধ ও কার
জন্য অবৈধ :
মহান আল্লাহ কুরআন ও ছহীহ
হাদীছে যাবতীয় বিধি-বিধান
দানের মাধ্যমে দ্বীন ইসলামকে
পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন।
রাসূ্ললুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ
ইসলামের বিধান মানার ক্ষেত্রে
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যতীত অন্য
কারো তাক্বলীদ করতেন না।
অনুরূপভাবে তাবেঈগণও নির্দিষ্ট
কোন ব্যক্তির তাক্বলীদ না করে
কেবলমাত্র কুরআন ও সুন্নাহর
ইত্তেবা করতেন। কিন্তু দুঃখের
বিষয় হ’ল, বর্তমান যুগে
মুসলমানগণ ইসলামের বিধান থেকে
অনেক দূরে সরে গেছে। এক্ষেত্রে
মানুষ তিন ভাগে বিভক্ত :
১- উচ্চ জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি,
যাঁরা মুজতাহিদ নামে খ্যাত। তাঁদের
জন্য অন্য কারো তাক্বলীদ করা
বৈধ নয়।
২- মধ্যম জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি,
যাঁরা তাফসীর, হাদীছ, ফিক্বহ
এবং আক্বীদায় যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন
করেছেন এবং দলীল গ্রহণের
ক্ষেত্রে ছহীহ ও যঈফ হাদীছের
মধ্যে পার্থক্য করতে সক্ষম, তাঁদের
জন্যও অন্য কারো তাক্বলীদ করা
বৈধ নয়।
৩- সাধারণ মানুষ, যাদের কুরআন ও
সুন্নাহর কোন জ্ঞান নেই, তাদের
জন্য উপরোক্ত দুই প্রকারের
অন্তর্ভুক্ত যেকোন আলেমের নিকট
জিজ্ঞেস করা বৈধ। কারণ আল্লাহ
বলেছেন-
َﺕَﻼْﻤُﺘْﻨُﻜْﻧِﺇِﺮْﻛِّﺬﻟﺎَﻠْﻫَﺃﺍﻮُﻟَﺄْﺳﺎَﻓ
َﻥْﻮُﻤَﻠْﻋ. ‘তোমরা যদি না জান,
তাহ’লে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস
কর’ (নাহল ৪৩)। তবে এক্ষেত্রে
নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির মত অথবা
নির্দিষ্ট কোন মাযহাবের
তাক্বলীদ বা অন্ধানুসরণ করা বৈধ
নয়।

নির্দিষ্ট কোন মাযহাবের
তাক্বলীদ করার হুকুম :
কোন মুসলিম ব্যক্তির জন্য (সে
শিক্ষিত হোক বা মূর্খই হোক)
নির্দিষ্ট কোন এক ব্যক্তির
তাক্বলীদ তথা বিনা দলীলে তার
থেকে সকল মাসআলা গ্রহণ করা
জায়েয নয়। পক্ষান্তরে চার
মাযহাবের যেকোন একটির অনুসরণ
করা ফরয মর্মে প্রচলিত কথাটি
ভিত্তিহীন এবং কুরআন ও সুন্নাহ
পরিপন্থী। কারণ আল্লাহ তা‘আলা
কোন ব্যক্তির অন্ধানুসরণ না করে
শুধু কুরআন ও সুন্নাহ অনুসরণ করার
নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা
বলেন-
ْﻢُﻜِّﺑَّﺮْﻨِّﻤْﻤُﻜْﻴَﻟِﺈَﻟِﺰْﻧُﺃﺎَﻣﺍْﻮُﻌِﺒَّﺗِﺍ
ْﻲِﻠَﻗَﺀﺎَﻴِﻟْﻭَﺄِﻬِﻧْﻭُﺪْﻨِﻣﺍْﻮُﻌِﺒَّﺘَﺗَﻻَﻭ
َﻥْﻭُﺮَّﻛَﺬَﺗﺎَّﻣًﻻ. ‘তোমাদের নিকট
তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে
যা অবতীর্ণ হয়েছে, তোমরা তার
অনুসরণ কর, আর তোমরা আল্লাহকে
ছেড়ে অন্য কাউকে বন্ধুরূপে অনুসরণ
করনা। তোমরা খুব অল্পই উপদেশ
গ্রহণ করে থাক’ (আ‘রাফ ৩)।
আর আল্লাহ তা‘আলা প্রেরিত বিধান
বুঝার জন্য যোগ্য আলেমের নিকটে
জিজ্ঞেস করার নির্দেশ দিয়ে
বলেন- ‘তোমরা যদি না জান তবে
জ্ঞানীগণকে জিজ্ঞেস কর’ (নাহল
৪৩)। অতএব শরী‘আতের অজানা
বিষয় সমূহ আলেমদের নিকট থেকে
জেনে নিতে হবে। এর অর্থ এই নয়
যে, নির্দিষ্ট কোন এক ব্যক্তির
তাক্বলীদ করতে হবে।
তাক্বলীদ একটি বহু প্রাচীন
জাহেলী প্রথা। বিগত উম্মতগুলির
অধঃপতনের মূলে তাক্বলীদ ছিল
সর্বাপেক্ষা ক্রিয়াশীল উপাদান।
তারা তাদের নবীদের পরে উম্মতের
বিদ্বান ও সাধু ব্যক্তিদের
অন্ধানুসরণ করে এবং ভক্তির
আতিশয্যে তাদেরকে রব-এর আসন
দিয়ে সম্মান প্রর্দশন করতে থাকে।
যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
ْﺭَﺄْﻤُﻬَﻧﺎَﺒْﻫُﺭَﻮْﻤُﻫَﺭﺎَﺒْﺣَﺃﺍْﻭُﺬَﺨَّﺗِﺍ
َﻦْﺑﺎَﺤْﻴِﺴَﻤْﻟﺍَﻮِﻬﻠﻟﺎِﻧْﻭُﺪْﻨِﻣﺎًﺑﺎَﺑ
َﻝِﺇﺍْﻭُﺪُﺒْﻌَﻴِﻟَّﻻِﺇﺍْﻭُﺮِﻣُﺃﺎَﻣَﻮَﻤَﻳْﺮَﻣ
َّﻢَﻌُﻬَﻧﺎَﺤْﺒُﺳَﻮُﻫَّﻻِﺈَﻬَﻟِﺇَﻻﺍًﺪِﺣﺍَﻭﺎًﻫ
َﻥْﻮُﻛِﺮْﺸُﻳﺍ. ‘তারা আল্লাহকে ছেড়ে
তাদের পন্ডিতগণ ও সংসার-
বিরাগীদের রব হিসাবে গ্রহণ
করেছে এবং মারিয়াম পুত্র
মাসীহকেও। অথচ তারা এক ইলাহের
ইবাদত করার জন্যই আদিষ্ট হয়েছে,
তিনি ব্যতীত কোন (হক) ইলাহ
নেই। তারা যে শরীক করে তিনি তা
থেকে পবিত্র’ (তওবা৩১)।

ইমাম রাযী (৫৪৪-৬০৬ হিঃ)
বলেন, অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে
উক্ত আয়াতে উল্লেখিত ‘আরবাব’
অর্থ এটা নয় যে, ইহুদী-নাছারাগণ
তাদেরকে বিশ্বচরাচরের ‘রব’ মনে
করত। বরং এর অর্থ হ’ল এই যে,
তারা তাদের আদেশ ও নিষেধ সমূহের
আনুগত্য করত। যেমন ইসলাম
গ্রহণের উদ্দেশ্যে নাছারা বিদ্বান
আদী বিন হাতিম রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
-এর দরবারে হাযির হ’লেন। তখন
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সূরায়ে তওবা
পড়ছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে
উপরোক্ত (তওবা ৩১) আয়াতে পৌঁছে
গেলেন। আদী বললেন, আমরা তাদের
ইবাদত করিনা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
জওয়াবে বললেন, আল্লাহ তা‘আলা
যেসব বস্ত্ত হালাল করেছেন তাকি
তারা হারাম করত না? অতঃপর
তোমরাও তাকে হারাম গণ্য করতে।
এমনিভাবে আল্লাহ তা‘আলা যেসব
বস্ত্ত হারাম করেছেন তা কি তারা
হালাল করত না? অতঃপর তোমরাও
তাকে হালাল গণ্য করতে। আদী
বললেন, হ্যাঁ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
বললেন, সেটাইতো তাদের ইবাদত
হ’ল। (ইমাম রাযী, তাফসীরুল
কাবীর ১৬/২৭; ডঃ মুহাম্মাদ
আসাদুল্লাহ আল-গালিব, আহলেহাদীছ
আন্দোলন উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিত সহ,
পৃঃ১৫১।)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
ﺎَﻟَﺰْﻧَﺃﺎَﻣﺍْﻮُﻌِﺒَّﺗﺎُﻤُﻬَﻠَﻠْﻴِﻗﺍَﺫِﺇَﻭ
َﻉﺎَﻨْﻴَﻔْﻟَﺃﺎَﻤُﻌِﺒَّﺘَﻨْﻠَﺑﺍْﻮُﻟﺎَﻘُﻬﻠﻟ
َﻼْﻤُﻫُﺅﺎَﺑﺂَﻧﺎَﻛْﻮَﻟَﻭَﺃﺎَﻧَﺀﺎَﺑﺂِﻬْﻴَﻟ
َﻥْﻭُﺪَﺘْﻬَﻳَﻻَﻭﺎًﺌْﻴَﺸَﻧْﻮُﻠِﻘْﻌَﻳ. ‘আর
যখন তাদেরকে বলা হয় আল্লাহ যা
নাযিল করেছেন, তোমরা তার
অনুসরণ কর, তারা বলে, বরং আমরা
অনুসরণ করব আমাদের পিতৃ-
পুরুষদেরকে যার উপর পেয়েছি। যদি
তাদের পিতৃ-পুরুষরা কিছু না বুঝে
এবং হেদায়াতপ্রাপ্ত না হয়,
তাহ’লেও কি’? (বাক্বারাহ ১৭০)
অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম রাযী
বলেন, আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে
নির্দেশ দিচ্ছেন যেন তারা তাঁর
নাযিলকৃত প্রকাশ্য দলীল সমূহের
অনুসরণ করে। কিন্তু তারা বলে যে,
আমরা ওসবের অনুসরণ করব না, বরং
আমরা আমাদের বাপ-দাদা ও পূর্ব
পুরুষদের অনুসরণ করব। তারা যেন
তাক্বলীদের মাধ্যমে দলীলকে
প্রতিরোধ করছে।
ইমাম রাযী বলেন, যদি মুক্বাল্লিদ
ব্যক্তিটিকে বলা হয় যে, কোন
মানুষের প্রতি তাক্বলীদ সিদ্ধ
হবার শর্ত হ’ল একথা জ্ঞাত হওয়া
যে, ঐব্যক্তি হক-এর উপরে আছেন,
একথা তুমি স্বীকার কর কি-না?
যদি স্বীকার কর তাহ’লে জিজ্ঞেস
করব তুমি কিভাবে জানলে যে
লোকটি হক-এর উপরে আছেন? যদি
তুমি অন্যের তাক্বলীদ করা দেখে
তাক্বলীদ করে থাক, তাহ’লে তো
গতানুগতিক ব্যাপার হয়ে গেল। আর
যদি তুমি তোমার জ্ঞান দ্বারা
উপলব্ধি করে থাক, তাহ’লে তো আর
তাক্বলীদের দরকার নেই, তোমার
জ্ঞানই যথেষ্ট। যদি তুমি বল যে,
ঐব্যক্তি হকপন্থী কি-না তা জানা
বা না জানার উপরে তাক্বলীদ
নির্ভর করে না, তাহ’লে তো বলা
হবে যে, ঐ ব্যক্তি বাতিলপন্থী
হ’লেও তুমি তার তাক্বলীদকে সিদ্ধ
করে নিলে। এমতাবস্থায় তুমি
জানতে পার না তুমি হকপন্থী না
বাতিলপন্থী। জেনে রাখা ভাল যে,
পূর্বের আয়াতে (বাক্বারাহ
১৬৮-১৭০) শয়তানের পদাংক
অনুসরণ না করার জন্য কঠোর
হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করার পরেই এই
আয়াত বর্ণনা করে আল্লাহপাক এ
বিষয়ে ইংগিত দিয়েছেন যে,
শয়তানী ধোঁকার অনুসরণ করা ও
তাক্বলীদ করার মধ্যে কোন
পার্থক্য নেই। অতএব এই আয়াতের
মধ্যে মযবুত প্রমাণ নিহিত রয়েছে
দলীলের অনুসরণ এবং চিন্তা-
গবেষণা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে ও
দলীলবিহীন কোন বিষয়ের দিকে
নিজেকে সমর্পণ না করার ব্যাপারে।
(তাফসীরুল কাবীর ৫/৭;
আহলেৃহাদীছ আন্দোলন উৎপত্তি ও
ক্রমবিকাশ দক্ষিণ এশিয়ার
প্রেক্ষিতসহ, পৃঃ ১৫৩-১৫৪।)
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে
তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, মানুষের
উপরে আল্লাহ, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
এবং আমীরের আনুগত্য করা
ওয়াজিব। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
ﺍﺍﻮُﻌْﻴِﻃَﺃﺍْﻮُﻨَﻣﺂَﻨْﻳِﺬَّﻟﺍﺎَﻬُّﻳَﺃﺎَﻳ
ْﻝﺎﻴِﻟْﻭُﺃَﻮَﻟْﻮُﺳَّﺮﻟﺍﺍﻮُﻌْﻴِﻃَﺃَﻮَﻬﻠﻟ
َﻑٍﺀْﻲَﺸْﻴِﻔْﻤُﺘْﻋَﺯﺎَﻨَﺘْﻧِﺈَﻔْﻤُﻜْﻨِﻣِﺮْﻣَﺃ
ُﺖْﻨُﻜْﻧِﺈِﻟْﻮُﺳَّﺮﻟﺍَﻮِﻬﻠﻟﺎﻯَﻟِﺈُﻫْﻭُّﺩُﺭ
ِﺮِﺧﺂْﻟﺎِﻣْﻮَﻴْﻟﺍَﻮِﻬﻠﻟﺎِﺒَﻧْﻮُﻨِﻣْﺆُﺘْﻣ
ًﻼْﻳِﻭْﺄَﺘُﻨَﺴْﺣَﺃَّﻭٌﺮْﻴَﺨَﻜِﻟٰٰﺫ- ‘হে
মুমিনগণ! তোমরা আনুগত্য কর
আল্লাহর , আনুগত্য কর রাসূলের এবং
আনুগত্যকর তোমাদের আমীরের যদি
তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস
কর। কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে
মতভেদ ঘটলে ফিরে চল আল্লাহ এবং
তাঁর রাসূলের দিকে। এটাই উত্তম
এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর’ (নিসা
৫৯)। সুতরাং আল্লাহ এবং তাঁর
রাসূলের আনুগত্য করার লক্ষ্যেই
আমীরের আনুগত্য করতে হবে।
অতঃপর পরস্পরে মতভেদ দেখা দিলে
ফিরে যেতে হবে আল্লাহ ও তাঁর
রাসূলের দিকে। আর যখন কোন নতুন
বিষয় আসবে তখন এমন আলেমের
নিকট জিজ্ঞেস করতে হবে, যিনি
কুরআন ও ছহীহ হাদীছ যাচাই করে
ফৎওয়া প্রদান করেন। এক্ষেত্রে
মাযহাবী গোঁড়ামিকে কখনোই স্থান
দেয়া যাবে না। অর্থাৎ একজন যোগ্য
আলেম- সে যে মাযহাবেরই অনুসারী
হোক না কেন, তাঁর কাছেই জিজ্ঞেস
করতে হবে। যদি কোন মানুষ
নির্দিষ্ট কোন মাযহাবের অনুসরণ
করে আর দেখে যে, কিছু মাসআলার
দলীল গ্রহণের ক্ষেত্রে তার
মাযহাব থেকে অন্য মাযহাবই
শক্তিশালী, তাহ’লে তার উপর
মাযহাবী গোঁড়ামি পরিত্যাগ করে
শক্তিশালী দলীল গ্রহণ করাই
ওয়াজিব। আর যদি কুরআন ও ছহীহ
হাদীছের উপর মাযহাবী
গোঁড়ামিকেই প্রাধান্য দেয়, তাহ’লে
সে পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
(ইবনে তায়মিয়াহ, মাজমূউ
ফাতাওয়া, ২০/২০৮-২০৯*

একদা শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়া
জিজ্ঞাসিত হ’লেন এমন এক
ব্যক্তি সম্পর্কে, যে নির্দিষ্ট
কোন এক মাযহাবের অনুসারী এবং
মাযহাব সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা
রাখেন। অতঃপর তিনি হাদীছ
গবেষণায় লিপ্ত হন এবং এমন কিছু
হাদীছ তার সামনে আসে যে
হাদীছগুলোর নাসখ, খাছ ও অপর
হাদীছের বিরোধী হওয়ার ব্যাপারে
তিনি কিছুই জানেন না। কিন্তু
তার মাযহাব হাদীছগুলোর
বিরোধী। এখন তার উপর কি
মাযহাবের অনুসরণ করা জায়েয, না
তার মাযহাব বিরোধী ছহীহ
হাদীছগুলোর উপর আমল করা
ওয়াজিব?
জওয়াবে তিনি বলেন, ‘কুরআন,
সুন্নাহ ও ইজমা দ্বারা প্রমাণিত
হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা মানুষের
উপর তাঁর ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য
করা ফরয করেছেন। রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) ব্যতীত পৃথিবীর কোন
মানুষের আনুগত্য তথা তার প্রতিটি
আদেশ-নিষেধ মান্য করাকে ফরয
করেননি, যদিও সে ব্যক্তি
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পরে
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ হয়। আর
সকলে ঐক্যমত পোষণ করেন যে,
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যতীত পৃথিবীর
কোন মানুষ মা‘ছূম বা নিষ্পাপ নয়,
যার প্রতিটি আদেশ-নিষেধ চোখ
বন্ধ করে গ্রহণ করা যেতে পারে।
আর ইমামগণ অর্থাৎ ইমাম আবু
হানীফা (রহঃ), ইমাম মালেক
(রহঃ), ইমাম শাফেঈ (রহঃ) ও
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)
সকলেই তাঁদের তাক্বলীদ করতে
নিষেধ করেছেন’। (ইবনে
তায়মিয়াহ, মাজমূউ ফাতাওয়া,
২০/২১০-২১৬।)
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ)
বলেন, কারো উপরই নির্দিষ্ট কোন
মাযহাবের তাক্বলীদ করা সিদ্ধ
নয়। এমনকি শারঈ বিষয়ে অজ্ঞ
ব্যক্তিদের কোন মাযহাব নেই।
কেননা মাযহাব তাদের জন্য যারা
মাযহাবের কিতাবপত্র পড়েছে এবং
অনুসরণীয় মাযহাবের ইমামদের
ফৎওয়া সম্পর্কে জ্ঞান রাখে।
পক্ষান্তরে যারা মাযহাব সম্পর্কে
জ্ঞানার্জন না করেই নিজেদেরকে
হানাফী, শাফেঈ, মালেকী ও
হাম্বলী বলে দাবী করে তাদের কথা
ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে নাহু না পড়ে
নিজেকে নাহুবিদ দাবী করে, ফিক্বহ
না পড়ে নিজেকে ফক্বীহ দাবী
করে’। (ইবনুল ক্বাইয়িম, ই‘লামুল
মুওয়াক্কি‘ঈন, ৬/২০৩-২০৫।)
ইবনু আবিল ইযয হানাফী (রহঃ)
বলেন, ‘যদি কোন ব্যক্তির সামনে
এমন কোন বিষয় উপস্থিত হয়, যে
বিষয়ের দলীল বা আল্লাহর বিধান
সম্পর্কে তার জানা না থাকে এবং
বিরোধী কোন মতও জানা না থাকে,
তাহ’লে তার উপর কোন ইমামের
তাক্বলীদ করা জায়েয’। কিন্তু যদি
তার সামনে দলীল স্পষ্ট হয়, আর
সে নির্দিষ্ট কোন ইমামের
তাক্বলীদকে জলাঞ্জলী দিয়ে উক্ত
দলীলকেই গ্রহণ করে, তাহ’লে সে
মুক্বাল্লিদ তথা কোন ব্যক্তির
অন্ধানুসারী না হয়ে মুত্তাবি তথা
কুরআন ও সুন্নাহর অনুসারী হিসাবে
পরিগণিত হবে।

আর যদি তার সামনে দলীল স্পষ্ট
হওয়ার পরও তার বিরুদ্ধাচরণ করে
অথবা দলীলকে বুঝার পরও তাকে
উপেক্ষা করে নির্দিষ্ট কোন
ব্যক্তির তাক্বলীদ করে, সে আল্লাহ
তা‘আলার অত্র বাণীর অন্তর্ভুক্ত
হবে,
ْﺮَﻘْﻴِﻔَﻜِﻠْﺒَﻘْﻨِﻣﺎَﻨْﻠَﺳْﺭَﺃﺎَﻤَﻜِﻟٰﺬَﻛَﻭ
ﺎَّﻧِﺇﺎَﻫْﻮُﻓَﺮْﺘُﻤَﻟﺎَﻗَّﻻِﺇٍﺮْﻳِﺬَّﻨْﻨِّﻣٍﺔَﻳ
َﻞَﻋﺎَّﻧِﺇَّﻭٍﺔَّﻣُﺄﻯَﻠَﻋﺎَﻧَﺀﺎَﺑﺁﺎَﻧْﺪَﺟَﻭ
َﻥْﻭُﺪَﺘْﻘُّﻤﻤِﻫِﺭﺎَﺛﺂﻯ- ‘এইভাবে
তোমার পূর্বে কোন জনপদে যখনই
আমি কোন সতর্ককারী প্রেরণ
করেছি, তখন তার সমৃদ্ধশালী
ব্যক্তিরা বলত, আমরা তো আমাদের
পূর্বপুরুষদেরকে পেয়েছি এক
মতাদর্শের অনুসারী এবং আমরা
তাদেরই পদাংক অনুসরণ
করছি’ (যুখরুফ ২৩)। ‘যখন
তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ যা
অবতীর্ণ করেছেন তোমরা তার
অনুসরণ কর, তখন তারা বলে, না;
বরং আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে
যার উপর পেয়েছি তার অনুসরণ
করব। এমনকি তাদের পিতৃপুরুষগণ
যদিও কিছুই বুঝত না এবং তারা
সৎপথেও পরিচালিত ছিল না,
তথাপিও’? (বাক্বারাহ ১৭০)।
(ইবনে আবিল ইযয হানাফী, আল-
ইত্তিবা, পৃঃ ৭৯-৮০।)
সাবেক সঊদী গ্র্যান্ড মুফতী,
বিশ্ববরেণ্য আলেমে রববানী
শায়খআব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ
বিন বায (রহঃ) বলেন, ‘চার
মাযহাবের কোন এক মাযহাবের
তাক্বলীদ করা ওয়াজিব’ মর্মে
প্রচলিত কথাটি নিঃসন্দেহে ভুল;
বরং চার মাযহাব সহ অন্যদের
তাক্বলীদ করা ওয়াজিব নয়। কেননা
কুরআন ও সান্নাহ-এর ইত্তেবা করার
মধ্যেই হক নিহিত আছে, কোন
ব্যক্তির তাক্বলীদের মধ্যে নয়’।
(আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন
বায, মাজমূউ ফাতাওয়া, ৩/৭২। )
অতএব নির্দিষ্ট কোন মাযহাবের
অন্ধানুসরণ করা নিকৃষ্ট বিদ‘আত,
যা অনুসরণ করার আদেশ কোন
ইমামই দেননি যারা আল্লাহ ও
তাঁররাসূল (ছাঃ)সম্পর্কে তাদের
অনুসারীদের চেয়ে বেশী অবগত।
সুতরাং নির্দিষ্ট কোন মাযহাবের
অন্ধানুসরণ না করে একমাত্র কুরআন
ও ছহীহ হাদীছের অনুসরণ করতে
হবে। যখনই ছহীহ হাদীছ পাওয়া
যাবে তখনই তা নিঃশর্ত ভাবে
অবনত মস্তকে মেনে নিতে হবে।

তাক্বলীদপন্থীদের দলীল ও তার
জবাব :
প্রথম দলীল : তাক্বলীদপন্থীদের
নিকট তাক্বলীদ জায়েয হওয়ার
সবচেয়ে শক্তিশালী দলীল হ’ল
আল্লাহ তা‘আলার বাণী-ﺍْﻮُﻟَﺄْﺳﺎَﻓ
َﻞْﻫَﺃ ِﺮْﻛِّﺬﻟﺍ ْﻥِﺇ ْﻢُﺘْﻨُﻛ َﻻ
َﻥْﻮُﻤَﻠْﻌَﺗ- ‘আর জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস
কর, যদি তোমরা না জেনে থাক’
(নাহল ৪৩)। আর আমরা অজ্ঞ
ব্যক্তি। অতএব আমাদের উপর
ওয়াজিব হ’ল আলেমদের নিকট
জিজ্ঞেস করা ও তাদের দেওয়া
ফৎওয়ার তাক্বলীদ করা।
জবাব : আয়াতে বর্ণিত ِﺮْﻛِّﺬﻟﺍ ُﻞْﻫَﺃ
কারা? তারাও যদি অন্য কারো
মুক্বাল্লিদ হয়, তাহ’লে তারা
অন্যদেরকেও ভুলের মধ্যে পতিত
করবে। আর যদি তারাই প্রকৃতُﻞْﻫَﺃ
ِﺮْﻛِّﺬﻟﺍ না হয়, তাহ’লে এতে
কুরআনের আয়াতের অপব্যাখ্যা করা
হবে।
আয়াতে বর্ণিত ِﺮْﻛِّﺬﻟﺍ ُﻞْﻫَﺃ -এর
ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মনীষীগণ
বিভিন্ন অভিমত পেশ করেছেন।
নিম্নে তা উল্লেখ করা হ’ল।-
ইমাম ইবনু হাযম (রহঃ) বলেন,
তারা হ’লেনﻦﻨﺴﻟﻼﻫﺃ তথা
সুন্নাতের অনুসারীগণ
অথবাﻲﺣﻮﻟﻼﻫﺃ অর্থাৎ অহী-র
বিধানের অনুসারী। (ইমাম ইবনু
হাযম, আল-ইহকাম ফী উছুলিল
আহকাম, পৃঃ ৮৩৮।)
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন,
ِﺮْﻛِّﺬﻟﺍ ُﻞْﻫَﺃ দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল,
ﺚﻳﺪﺤﻟﺍﻭ ﻥﺁﺮﻘﻟﺍ ﻞﻫﺃ অর্থাৎ
কুরআন ও হাদীছের অনুসারীগণ।
ইমাম ইবনে হাযম (রহঃ) আরো
বলেন, ِﺮْﻛِّﺬﻟﺎُﻠْﻫَﺃ দ্বারা উদ্দেশ্য
হ’ল, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে যারা
হাদীছ বর্ণনা করেছেন এবং
কুরআনের আহকাম সম্পর্কে জ্ঞান
সম্পন্ন আলেমগণ। যেমন আল্লাহ
তা‘আলা বলেন,
َﻞُﻬَﻟﺎَّﻧِﺇَﻭَﺮْﻛِّﺬﻟﺍﺎَﻨْﻟَّﺰَﻨُﻨْﺤَﻧﺎَّﻧِﺇ
َﻥْﻮُﻈِﻓﺎَﺣ ‘নিশ্চয়ই আমি কুরআন
নাযিল করেছি, আর আমিই তার
হিফাযতকারী’ (হিজর ৯)। অতএব
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে কুরআন ও
সুন্নাহ সম্পর্কে পারদর্শী
আলেমদেরকে জিজ্ঞেস করার নির্দেশ
দিয়েছেন। অনুরূপভাবে তাঁদের
প্রতিও এনির্দেশ দিয়েছেন যে,
তাঁরা যেন মানুষকে কুরআন ও সুন্নাহ
সম্পর্কে যথাযথ সংবাদ দেন।
তেমনি তাঁদের ভ্রষ্ট মতামত
প্রদান ও মিথ্যা ধারণার
ভিত্তিতে দ্বীনের মধ্যে নতুন
কিছুকে বৈধ করার অনুমতি দেননি।
(আল-ইহকাম ফী উছুলিল আহকাম,
পৃঃ ৮৩৮।)
আল্লাহ মুসলিম জাতিকে অহি তথা
পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ
অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)ও আমাদেরকে একই
নির্দেশ প্রদান করেছেন। আল্লাহ
তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর
স্ত্রীদেরকে নির্দেশ দিয়ে বলেন,
ﺂْﻨِﻤَّﻧُﻚِﺗْﻮُﻴُﺒْﻴِﻔﻯَﻠْﺘُﻳﺎَﻤَﻧْﺮُﻛْﺫﺍَﻭ
ﻞﻟﺎَّﻧِﺇِﺔَﻤْﻜِﺤْﻟﺍَﻮِﻬﻠﻟﺎِﺗﺎَﻳ
ﺍًﺮْﻴِﺒَﺧﺎًﻔْﻴِﻄَﻟَﻥﺎَﻜَﻫ – ‘আর
তোমাদের ঘরে আল্লাহর যে
আয়াতসমূহ ও হিকমত পঠিত হয়, তা
তোমরা স্মরণ রেখ। নিশ্চয়ই
আল্লাহ অতি সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক
অবহিত’ (আহযাব ৩৪)। অতএব
আমাদের সকলের উপর ওয়াজিব হ’ল
কুরআন ও সুন্নাহর ইত্তেবা করা।
আর কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে অজ্ঞ
ব্যক্তিদের যেকোন যোগ্য আলেমের
নিকট শরী‘আতের বিধান সম্পর্কে
জিজ্ঞেস করা। এক্ষেত্রে
নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির
তাক্বলীদ বা অন্ধানুসরণ না করা।
যেমন আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ)
অন্যান্য ছাহাবীদেরকে রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ)-এর কথা, কর্ম এবং সুন্নাহ
সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন। এছাড়া
অন্য কিছু জিজ্ঞেস করতেন না।
অনুরূপভাবে ছাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ)-এর স্ত্রীগণকে বিশেষ করে
আয়েশা (রাঃ)-কে তাঁর বাড়ির
অভ্যন্তরের কাজ সম্পর্কে জিজ্ঞেস
করতেন। ফক্বীহগণের মধ্যেও
অনুরূপ বিষয় লক্ষ্য করা যায়।
যেমন ইমাম শাফেঈ (রহঃ) ইমাম
আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-কে
বলেছেন,
ﺢﻟﺎﺒﻤﻠﻋﺄﺘﻧﺄﻬﻠﻟﺍﺪﺒﻋﺎﺑﺃﺎﻳ
ﻉﺄﻔﺜﻳﺪﺤﻟﺎﺤﺻﺍﺫﺈﻓ،ﻲﻨﻤﺜﻳﺩ
ﻥﺎﻛﺎﻴﻣﺎﺸﻬﻴﻟﺈﺒﻫﺫﺃﻲﺘﺤﻴﻨﻤﻟ
ﺎﻳﺮﺼﺑﻭﺃﺎﻴﻓﻮﻛﻭﺃ ‘হে আবু
আব্দুল্লাহ! আপনি আমার চেয়ে
হাদীছ সম্পর্কে অধিক জ্ঞান
রাখেন, যখন ছহীহ হাদীছ পাবেন,
তখন তা আমাকে শিক্ষা দিবেন।
যদিও তা গ্রহণ করার জন্য আমাকে
শাম, কুফা অথবা বাছরায় যেতে হয়’।
(ইবনুল ক্বাইয়িম, ই’লামুল
মুয়াক্কিঈন ২/১৬৪; আবু আব্দুর
রহমান সাঈদ মা‘শাশা, আল-
মুকাল্লিদূন ওয়াল আইম্মাতুল
আরবা‘আহ, পৃঃ ৯৪।) অতীতে
আলেমগণের মধ্যে কেউ এমন ছিলেন
না যে, তিনি নির্দিষ্ট কোন এক
ব্যক্তির বা মাযহাবের রায় বা
অভিমত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন
এবং অনুসরণীয় ব্যক্তি বা
মাযহাবের রায়কেই গ্রহণ করতেন
এবং অন্যান্য রায়ের বিরোধিতা
করতেন। (ই’লামুল মুয়াক্কিঈন
২/১৬৪।)

মানুষের হিসাব নিকাশের সময় নিকটবর্তী অথচ তারা বেখবর হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে

image

“মানুষের হিসাব নিকাশের সময়
নিকটবর্তী অথচ তারা বেখবর হয়ে মুখ
ফিরিয়ে নিচ্ছে।” (সুরা আম্বিয়া, ২১ :
১)
সুতরাং যখন নির্ধারিত সময় আসবে এবং
জগৎসমূহের স্রষ্টার সম্মুখে মানুষের দাঁড়ানোর
সময় নিকটবর্তী হবে:
“শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে —
একটিমাত্র ফুৎকার এবং পৃথিবী ও
পর্বতমালা উত্তোলিত হবে ও চূর্ণ
বিচূর্ণ করে দেয়া হবে।” (সুরা হাক্কাহ,
৬৯ : ১৩-১৪)
তখন যা অবশ্যম্ভাবী তা ঘটবে এবং বিচার
দিবস নিকটে আনা হবে এবং প্রকৃত সত্যকে
প্রকাশ করা হবে এবং চূড়ান্ত ঘন্টার আগমন
ধ্বনিত হবে:
“এটা তো হবে কেবল এক মহা মহানাদ। সে
মুহূর্তেই তাদের সবাইকে আমার সামনে
উপস্থিত করা হবে।”(সুরা ইয়াসীন,
৩৬ : ৫৩)
এবং তারা
“কবর হতে তাদের পালনকর্তার দিকে ছুটে
চলবে।” (সুরা ইয়াসীন, ৩৬ : ৫১)
দ্বিধাগ্রস্তভাবে এবং দ্রুততার সাথে, তারা
বলবে:
“হায় আমাদের দুর্ভোগ! কে আমাদেরকে
নিদ্রাস্থল থেকে উত্থিত করল?
(তাদেরকে বলা হবে) : রহমান আল্লাহ তো
এরই ওয়াদা দিয়েছিলেন এবং রাসূলগণ
সত্য বলেছিলেন।” (সুরা ইয়াসীন, ৩৬ :
৫২)
“সুতরাং মৃদু গুঞ্জন ব্যতীত তুমি কিছুই
শুনবে না।” (সুরা ত্বহা, ২০ : ১০৮)
তখন গলা শুকিয়ে যাবে সুতরাং
“এটা এমন দিন, যেদিন কেউ কথা বলবে
না এবং কাউকে তওবা করার অনুমতি দেয়া
হবে না।” (সুরা মুরসালাত, ৭৭ : ৩৫-৩৬)
এবং তাদের দৃষ্টি অবনমিত থাকবে এবং
অবমাননা তাদেরকে গ্রাস করবে:
“সেই চিরজীবী চিরস্থায়ীর সামনে সব
মুখমণ্ডল অবনমিত হবে এবং সে ব্যর্থ
হবে যে জুলুমের বোঝা বহন করবে।” (সুরা
ত্বহা, ২০ : ১১১)
এবং
“সেদিন কোন কোন মুখ উজ্জ্বল হবে আর
কোন কোন মুখ হবে কালো।” (সুরা আলি
ইমরান, ৩ : ১৬)
তখন মানুষ দুই দলে বিভক্ত হবে:
“একদল জান্নাতে এবং একদল জাহান্নামে
প্রবেশ করবে।” (সুরা আশ শূরা, ৪২ : ৭)
অতপর, দুর্দশাগ্রস্ত ব্যক্তির জন্য তাদের
দুরবস্থার জন্য দুর্ভোগ এবং তাদের শেষ
অবস্থার করুণ পরিণতির জন্য তাদের উপর
পুনরায় দুর্ভোগ।
“আর যদি আপনি দেখেন যখন তাদেরকে
প্রতিপালকের সামনে দাঁড় করানো হবে।
তিনি বলবেন : এটা কি বাস্তব সত্য
নয়।” (সুরা আনআম, ৬ : ৩০)
তখন তারা শুধু একথাই বলবে:
“হ্যাঁ আমাদের প্রতিপালকের
কসম।” (সুরা আনআম, ৬ : ৩০)
বাস্তবিকই তারা রাসূলের ডাকে সাড়া দেয়নি,
কিন্তু তারা শপথ করত (যে তারা পুনরুত্থিত
হবে না) যতক্ষণ তাদেরকে না দেখানো হবে এবং
তাদের বিভ্রান্তি দূর করা না হবে, সুতরাং
সৃষ্টির সূচনাকারী তাদের বলবেন:
“অতএব, তোমরা আস্বাদন কর, আমি কেবল
তোমাদের শাস্তিই বৃদ্ধি করব।” (সূরা
নাবা, ৭৮ : ৩০)
“যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ
করে, কিয়ামতের দিন আপনি তাদের মুখ
কালো দেখবেন। অহংকারীদের আবাসস্থল
জাহান্নামে নয় কি?” (সুরা আ– ৩৯ : ৬০)
পুনরুত্থানে অবিশ্বাসী বস্তুবাদীরা, যারা বলত
:
“আমাদের এ পার্থিব জীবনই জীবন,
আমাদেরকে পুনরায় জীবিত হতে হবে
না।” (সুরা আনআম, ৬ : ২৯)
অথবা যারা আল্লাহর রাসূলদের এবং তাদের
আহ্বানকে বাধা দিয়েছিল, তারা শাস্তির এবং
চূড়ান্ত ন্যায়বিচারের সেই দিনটিতে উপনীত,
যেদিন
“কারও প্রতি জুলুম করা হবে না এবং
তোমরা যা করবে, কেবল তারই প্রতিদান
পাবে।” (সুরা ইয়াসীন, ৩৬ : ৫৪)
তারা তাদের চোখ, হৃদয়, কানকে সত্যের
প্রতিটি আলো থেকে বিমুখ রেখেছিল। সেজন্য
তাদের শাস্তি:
“আমি কেয়ামতের দিন তাদের সমবেত
করব, তাদের মুখে ভর দিয়ে চলা অবস্থায়,
অন্ধ অবস্থায়, মূক অবস্থায় এবং বধির
অবস্থায়। তাদের আবাসস্থল
জাহান্নাম।” (সুরা বনী ইসরাইল, ১৭ :
৯৭)
তাই তাদের মধ্যে একজন বলবে :
“হে আমার পালনকর্তা, আমাকে কেন অন্ধ
অবস্থায় উত্থিত করলেন? আমি তো
চক্ষুষ্মান ছিলাম। আল্লাহ বলবেন,
এমনিভাবে তোমার কাছে আমার
আয়াতসমূহ এসেছিল, অতঃপর তুমি
সেগুলো ভুলে গিয়েছিলে। তেমনিভাবে
আজ আমি তোমাকে ভুলে যাব।” (সুরা
তোয়াহা, ২০ : ১২৫-১২৬)
তাদের হৃদয় অনুতাপে ক্ষতবিক্ষত হবে যাবে এবং
“যালিম সেদিন আপন হস্তদ্বয় দংশন
করতে করতে বলবে, হায় আপসোস আমি
যদি রাসূলের পথ অবলম্বন করতাম! হায়
আমার দুর্ভাগ্য আমি যদি অমুককে
বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম!” (সুরা
ফুরকান, ২৫ : ২৭)
এবং দুনিয়ার দিনগুলো সম্পর্কে পাপীরা তখন
বলবে :
“হায় আফসোস এর ব্যাপারে আমরা কতই
না ত্রুটি করেছি! তারা স্বীয় স্বীয়
বোঝা পৃষ্ঠে বহন করবে। শুনে রাখ, তারা
যে বোঝা বহন করবে, তা নিকৃষ্টতর
বোঝা। পার্থিব জীবন ক্রীড়া ও কৌতুক
ব্যতীত কিছুই নয়। পরকালের আবাস
মুত্তাকীদের জন্য শ্রেষ্ঠতর। তোমরা
কি বোঝ না?” (সুরা আনআম, ৬ : ৩১ –
৩২)
হায় সেই দিনটি কী ভয়ংকরই না হবে এবং এর
ত্রাস কতই না ভীতিপ্রদ হবে! সেই ব্যক্তিই
প্রকৃতপক্ষে মুক্তিপ্রাপ্ত হবে, যে ঐ দিনে
মুক্তি পাবে এবং সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে যার পাপ
তাকে ঐদিন ধ্বংস করবে। এ ধরনের দৃষ্টান্তের
ব্যাপারে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। তাই আসুন
আমরা প্রত্যাবর্তন করি এবং নিজেদের
আত্মাকে প্রশ্ন করি, তাকে আল্লাহর আনুগত্যে
বাধ্য করি, একে পবিত্র করে তুলি এবং উৎসাহ
সহকারে একাজে আত্মনিয়োগ করি।

ইমাম আবু দাঊদ রহঃ এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

ইমাম আবু দাঊদ (রহঃ)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
ইমাম আবু দাউদ (রহঃ) ইলমে হাদীসের সুবিশাল
পরিমণ্ডলের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।
হাদীসশাস্ত্রে অবদানের জন্য যে ক’জন মনীষী
স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি তাঁদের অন্যতম।
তিনি একজন ইমাম, শায়খুস সুন্নাহ, প্রথম
সারির হাফিয ও উঁচ্চ মযাদা সম্পন্ন
ব্যক্তি।
জন্ম ও বংশ :
নাম সুলায়মান, কুনিয়াত আবু দাউদ। পিতার নাম
আশাআস। তাঁর পুরো নাম আবু দাউদ সুলায়মান
ইবনুল আশ’আস ইবনু শাদ্দাদ ইবনু আমর ইবনু
‘আমি। তাকে সুলায়মান ইবনুল আশ’আস ইবনু
ইসহাকু আল-আসাদী আল-সিজিস্তানীও বলা
হয়। ইমাম আবু দাউদ ২০২ হিজরী মোতাবেক
৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে কান্দাহার ও চিশতের
নিকটবর্তী সিজিস্তানে জন্ম গ্রহণ করেন।
শিক্ষা জীবন :
তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা জীবন স্মপর্কে জানা
যায় না। সম্ভবত তিনি নিজ গ্রামেই
প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ইমাম আবু
দাউদের বয়স যখন দশ বছর তখন তিনি
নিশাপুরের একটি মাদরাসায় ভর্তি হন এবং
সেখানেই তিনি প্রখ্যাত মুহাদিস ইবনু
আসলামের নিকট হাদীসশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন।
অতঃপর তিনি হাদীসে উচ্চ শিক্ষা লাভের
জন্য মিশর, সিরিয়া, হিজাজ, ইরাক, খুরাসান
প্রভৃতি বিখ্যাত হাদীস গবেষণা কেন্দ্র সমূহে
ভ্রমণ করেন এবং তদানিন্তন সুবিখ্যাত
মুদাদ্দিসগণের নিকট হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহ
করেন।
চরিত্র :
ইমাম আবু দাউদ ছিলেন ইবাদাতগুযার,
পরহেযগার, যাহিদ ও ন্যায়পরায়ণ লোক।
দুনিয়ার ভোগ বিলাসের প্রতি তাঁর কোন মোহ
ছিল না। ইমাম ইবনু দাসাহ উল্লেখ করেন যে,
ইমাম আবু দাউদের জামার একটি হাতা প্রশস্ত ও
একটি হাত সংকৃর্ণ ছিল। এর কারণ জিজ্ঞাসা
করা হলে তিনি বলেন, যে হাতাটি প্রশস্ত তার
মধ্যে আমি লিখিত হাদীসগুলো রেখে দেই এবং
যে সংকৃর্ণ হাতার মধ্যে এ জাতীয় কিছুই নেই।
ইমাম আবু দাউদ সম্পর্কে মন্তব্য :
১। মূসা ইবনু হারুন বলেনঃ ইমাম আবু দাউদ
দুনিয়াতে হাদীসের খিদমাতের জন্য এবং
অখিরাতে জান্নাত লাভের জন্য সৃষ্টি হয়েছেন।
আমি তাঁর থেকে উত্তম ব্যক্তি দেখিনি ।
২। ইমাম হাকিম বলেনঃ নিঃসন্দেহে ইমাম আবু
দাউদ তাঁর সমসাময়িক মুহাদ্দিসগণের মধ্যে
শ্রেষ্ঠ ছিলেন। তাঁর এই শ্রেষ্ঠত্ব ছিল
নিরংকুশ ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী ।
৩। ইমাম যাহাবী বলেনঃ ইমাম আবু দাউদ
হাদীসের ইমাম হওয়ার পাশাপাশি একজন বড়
মাপের ফাক্বীহ ছিলেন। তাঁর কিতাবই এর
প্রমাণ বহণ করে।
৪। হাফিয আবু আবদুল্লাহ ইবনু মানদাহ বলেন
যাঁরা হাদীস বর্ণনা করে তন্মধ্যকার দোষযুক্ত
হাদীসগুলো থেকে প্রমাণযোগ্য হাদীসগুলোকে
এবং ভুল থেকে শুদ্ধকে পৃথক করেছেন, তাঁরা
হচ্ছেন চারজনঃ বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ ও
নাসায়ী।
৫। ইবরাহীম ইবনু ইসহাক্ব বলেনঃ ইমাম আবু
দাউদের জন্য হাদীসকে নরম ও সহজ করে দেয়া
হয়েছিল ঠিক যেমনিভাবে নরম ও সহজ করে
দেয়া হয়েছিল দাউদ নাবীর জন্য লৌহকে ।
৬। মাসলামাহ ইবনু ক্বানিম বলেনঃ আবু দাউদ
ছিলেন নির্ভরযোগ্য, যাহিদ, হাদীস
সম্পর্কে সম্যক অবগত এবং এ বিষয়ে তাঁর
যুগের ইমাম ।
৭। আর-রাযী বলেনঃ আমি তাঁকে বাগদাদে
দেখেছি। তিনি আমার পিতার কাছে আসতেন।
তিনি একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি ছিলেন।
৮। ঐতিহাসিক ইবনু তাগরিদী বলেনঃ তিনি
ছিরেন হাদীসের হাফিয, সমালোচক,
সুক্ষাতিসুক্ষ ক্রটি সম্পর্কে অবহিত
আল্লাহভীরু এক মহান ব্যক্তি।
শিক্ষকগণ :
বিভিন্নদেশ ও শহরে ইমাম আবু দাউদের
শিক্ষকের সংখ্যা অসংখ্য। তিনি উঁচু মাপের
বহু মুহাদ্দিসের কাছে হাদীস শিক্ষা, সংগ্রহ ও
শ্রবণ করেছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন
মাক্বাহতে কা’নাবী, সুলায়মান ইবনু হারব,
বাসরাহয় মুসলিম ইবনু ইবরাহীম, ‘আবদুল্লাহ
ইবনু রাজা, আবুল ওয়ালীদ তায়ালিসি, মূসা ইবনু
ইসমাঈল ও তাঁদের সমপর্যায়ের মুহাদ্দিসগণ
হতে, কূফা শহরে হাসান ইবনু রবীঈ বুরানী,
আহমাদ ইবনু ইউনূস ও একটি দল হতে, হালবে আবু
তাওবাহ আর-রাবী’ ইবনু নাফি’ হতে, বাহরাইনে
আবু জা’ফার নুফাইলী, আহমাদ ইবনু আবু শু’আইব ও
আরো অনেকের কাছ থেকে, হিমসে হাইওয়াতাহ
ইবনু শুরাইহ, ইয়াযীদ ইবনু ‘আবদে রাব্বী হতে,
দামিস্কে সাফওয়ান ইবনু সালিহ ও হিশাম ইবনু
আম্মার হতে, খুরাসানে ইসহাক্ব ইবনু
রাহওয়াইহি ও তাঁর সমপর্যায়ের ব্যক্তিদের
থেকে, বাগদাদে আহমাদ ইবনু হাম্বাল ও তাঁর
সমপর্যায়ের মুহাদ্দিস হতে, বালখাতে কুতাইবাহ
ইবনু সাবীদ হতে, মিসরে আহমাদ ইবনু সালিহ ও
অন্যদের থেকে। এছাড়াও ইবরাহীম ইবনু
বাশমার, ইবরাহীম ইবনু মূসা আর-অপররা, আলী
ইবনুল মাদীনী, হাকাম ইবনু মূসা, সাঈদ ইবনু
মানসূর, সাহল ইবনু বাক্কার, ‘আবদুর রহমান
ইবনুল মুবারক আবু-আয়শী, আবদুস সারাম ইবনু
মুত্ত্বাহহার, মুহাম্মদ ইবনু কাসীর, মু’আয ইবনু
আসাদ, আলী ইবনুল জা’দ, খালফ ইবনু হিশাম,
আমর ইবনু ‘আওন, ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন ও
অন্যান্য ইমামগণ।
ছাত্রবৃন্দ :
ইমাম আবু দাউদের ছাত্র সংখ্যাও অসংখ্য।
তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- ইমাম আবু ঈসা
তিরমিযী, আন-নাসায়ী, আবু আওয়ানাহ, আবু
হামিদ আহমাদ ইবনু জাফার আশ’আরী
আসবাহানী, আবূ ‘আমর আহমাদ ইবনু আলী ইবনু
হাসান বাসরী, আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ খাল্লাল
ফাক্বীহ, ইসহাক্ব ইবনু মূসা রমলী, ইসমাঈল
ইবনু সাফফার, হুসাইন ইবনু ইদরীস আল-হারুবী,
যাকারিয়্যাহ ইবনু ইয়াহইয়া সাজী, আবু বাকর
ইবনু দুনয়া, আবু দাউদের পুত্র আবু বাকর,
মুহাম্মাদ ইবনু জা’ফার ফিরয়াবী, আবূ বিশর
দুলাবী, আবু ‘আলী মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ
লু’লুয়ী, মুহাম্মাদ ইবনু রাজ বাসরী, আবূ সালিম
মুহাম্মাদ ইবনু সাঈদ আদামী, মুহাম্মাদ ইবনু
মুনযির, উসামাহ মুহাম্মাদ ইবনু ‘আবদুল মালিক,
হাসান ইবনু ‘আবদুল্লাহ, মুহাম্মাদ ইবনু
ইয়াহইয়া মরদাস, আবু বাকর মুহাম্মাদ ইবনু
ইয়াহইয়া প্রমূখ।
ইমাম আবু দাউদ সূত্রে যাঁরা সুনান গ্রন্থখানি
বর্ণনা করেছেনঃ
ইমাম আবু দাউদের নিকট হতে তাঁর এ
গ্রন্থখানি ধারাবাহিক সূত্র পরম্পরায় প্রায়
নয়-দশজন বড় বড় মুহাদিস কর্তৃক বর্ণিত
হয়েছে- (মুকুদ্দামাহ গায়াতুল মাক্বসুদ)। যেমনঃ
১। আবু ত্বাইয়্যিব আহমাদ ইবনু ইবরাহীম
আশনানী বাগদাদী।
২। আবু আমর আহমাদ ইবনু আলী ইবনু হাসান
বাসরী।
৩। আবু সাউদ ইবনুল আ’রাবী ।
৪। আরী ইবনুল হাসান ইবনুল আবদ আল-
আনসারী।
৫। আবু আলী মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ লু’লুয়ী ।
৬ মুহাম্মাদ ইবনু বাকর দাসাহ।
৭। আবু উসামাহ মুহাম্মাদ ইবনু আবদুল মালিক।
এছাড়াও অন্যরা।
ইমাম আবু দাউদের রচিত গ্রন্থাবলীঃ
ইমাম আবু দাউদ বহু মূল্যবান গ্রন্থাবলী রচনা
করেছেন। তন্মেধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেঃ
১। ইবতিদাউল ওয়াহী।
২। আখবারুল খাওয়ারিজ।
৩। আ’লামুন নাবুয়্যাহ ।
৪। কিতাবু মা তাফাররাদা বিহী আহলুল
আমসার।
৫। আদ-দু’আ।
৬। আয-যুহদ।
৭। কিতাবুস সুনান। যা ছয়টি প্রসিদ্ধ হাদীস
গ্রন্থের একটি।
৮। কিতাবু ফাযায়িলে আনসার।
৯। আর রাদ্দু ‘আলাল ক্বাদরিয়্যাহ।
১০। আল-মারাসীল।
১১। আল-মাসায়িল।
১২। মুসনাদে মালিক ইবনু আনাস।
১৩। নাসিখ ওয়াল মানসূখ।
১৪ । মারিফাতুল আওকাত।
মৃত্যঃ ইলমে হাদীসের এ মহান ব্যক্তি ২৭৫
হিজরী সালের ১৬ শাওয়াল ৭৩ বছর বয়সে
বাসরাহ নগরে ইন্তিকাল করেন।
সুনান আবু দাউদের ব্যাখ্যা গ্রন্থাবলীঃ
সুনান আবু দাউদের অনেকগুলো ব্যাখ্যা গ্রন্থ
রচিত হয়েছে। তন্মধ্যে প্রসিদ্ধ কয়েকটি
গ্রন্থ হচ্ছেঃ
১। ইমাম খাত্তাবীর মা’আলিমুস সুনান।
২। শামসুল হাক্ব ‘আযীমাবাদীর ‘আওনুল মা’বুদ।
৩। বাজলুল মাজহুদ ফী হাল্লি আবু দাউদ।
এছাড়াও অন্যান্য।
সুনান আবু দাউদ গ্রন্থটির বৈশিষ্ট্য ও
গ্রহণযোগ্যতাঃ
ইমাম আবু দাউদ (রহঃ)-এর সুনান গ্রন্থ স্বীয়
বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। গ্রন্থখানির
উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছেঃ এটি একটি
সুনান গ্রন্থ। এতে শারী’আতের হুকুম-আহকাম
এবং ব্যবহারিক জীবনের প্রয়োজনীয় নিয়ম-
নীতি সম্পর্কিত হাদীস সমূহ রয়েছে এবং
গ্রন্থটি ইমাম আবু দাউদ ফিক্বাহ কিতাবের
ন্যায় অধ্যায় ও অনুচ্ছেদ সাজিয়েছেন এবং
ফিক্বাহর দৃষ্টিভঙ্গিতে হাদীসসমূহ চয়ন
করেছেন। তাইতো ফিকাহবিদগণ বলেছেনঃ
“একজন মুজতাহিদের পক্ষে ফিক্বাহর মাসআলাহ
বের করার জন্য আল্লাহর কিতাব কুরআন
মাজীদের পরে এই সুনানে আবু দাউদ গ্রন্থই
যথেষ্ট”-(আল-হাদীসুল মুহাদিসুন, পৃঃ ৪১১)।
ইমাম আবু দাউদ পাঁচ লক্ষ হাদীস থেকে
অত্যধিক যাচাই বাছাই করে মাত্র প্রায় পাঁচ
হাজার হাদীস এতে স্থান দিয়েছেন। তিনি
নিজেই বলেছেন: “আমি রসূলুল্লাহ (সা.)-এর ৫
লক্ষ হাদীস লিপিবদ্ধ করেছিলাম। তার মধ্য
থেকে যাচাই বাছাই করে মনোনীত হাদীস এ
গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছি। এ গ্রন্থে
সুলাসিয়ত অৰ্থাৎ সাহাবীর স্তর থেকে তাঁর
পযন্ত তিনজন বর্ণনাকারী বিশিষ্ট
অনেকগুলো হাদীস রয়েছে। ইমাম আবু দাউদ
গ্রন্থটিতে সন্নিবেশিত হাদীসসমূহ ভিন্ন
ভিন্ন শিরোনামে উপস্থাপন করেছেন এবং
বর্ণিত হাদীস ও তার সানাদ সম্পর্কে
আপত্তিকর কিছু দেখতে “ইমাম আবু দাউদ
বলেছেন” বলে মন্তব্য পেশ করেছেন। এ
গ্রন্থখানি সর্বজনগ্রাহ্য সংকলনের মর্যাদা
অর্জন করেছে। এ সম্পর্কে স্বয়ং ইমাম আবু
দাউদ (রহঃ) বলেনঃ “জনগন কর্তৃক
সর্বসম্মতভাবে পরিত্যক্ত কোন হাদীসই আমি
এতে উদ্ধৃত করি নাই”- (দেখুন, খাত্তাবীর
মুকাদ্দামাহ মা’আলিমুস সুনান, পৃঃ ১৭)।
সর্বোপরি এটি বিজ্ঞ মুহাদিস ও
মণীষীগণের নিকট সমধিক গ্রহণযোগ্য
একটি গ্রন্থ। ইমাম আবু দাউদ গ্রন্থ সংকলন
সমাপ্ত করার পর তাঁর উস্তাদ ইমাম আহমাদ
ইবনু হাম্বালের সম্মুখে উপস্থাপিত করলে ইমাম
আহমাদ গ্রন্থখানিকে খুবই পছন্দ করেন এবং
একে একটি উত্তম হাদীস গ্রন্থ আখ্যায়িত
করে প্রশংসা করেন- (তাযকিরাতুল হুফফায,
মুনযিরীর মুকাদ্দামাহ তালখীস, পৃঃ ৫)।
ইমাম আবু দাউদে ছাত্র হাফিয মুহামআদ ইবনু
মাখরাস দুয়ারী (মৃত ৩৩১হিঃ) বলেনঃ “ইমাম
আবু দাউদ যখন সুনান গ্রন্থখানি প্রণয়ন
সম্পন্ন করলেন এবং তা লোকদের পাঠ করে
শুনালেন, তখনি তা মুহাদিসগণের নিকট
(কুরআনের মতই) অনুসরণীয় গ্রন্থ হয়ে গেল”-
(তাহযীবুত তাহযীব)।
হাফিয আবু জা’ফর ইবনু যুবাইর গরনাতী বলেনঃ
“ফিক্বাহ সম্পকিত হাদীসসমূহ সামগ্রিক ও
নিরংকুশভাবে সংকলিত হওয়ার কারণে সুনান আবু
দাউদের যে বিশেষত্ব, তা সিহাহ সিত্তার অপর
কোন গ্রন্থেরই নেই”- (তাদরীবুর রাবী, পৃঃ
৫৬)।
ইমাম গাযযালী (রহঃ) বলেনঃ “হাদীসের মধ্যে
এই একখানি গ্রন্থই মুজতাহিদের জন্য
যথেষ্ট”- (সাখাবীর ফাতহুল মুগীস, পৃঃ ২৮)।
মুহাদ্দিস যাকারিয়া সাজী বলেনঃ “ইসলামের
মূল হচ্ছে আল্লাহর কিতাব, আর ইসলামের
ফরমান হচ্ছে সুনানে আবু দাউদ”- (ইবনু
ত্বাহিরের শুরুতুল আয়িম্মাহ, পৃঃ ১৭)।
ইমাম খাত্তাবী বলেনঃ “আবু দাউদের সুনান
গ্রন্থ একটি মর্যাদাপূর্ণ গ্রন্থ। ইলমে দীন
সম্পর্কে এর সমতুল্য কোন গ্রন্থ রচিত
হয়নি”। মূলতঃ এ সুনান গ্রন্থখানি ইমাম আবু
দাউদ (রহঃ)-কে হাদীসশাস্ত্রে অসাধারণ
সম্মানের আসনে সমাসীন করেছে।
সূত্র: আলবানী একাডেমী থেকে প্রকশিত সুনান
আবু দাউদ হতে সংকলিত

মনের কষ্ট কে সারাবেন যেভাবে

মূল প্রবন্ধ : ইয়াসমিন মোজাহেদ | ভাষান্তর :
মোঃ মুনিমুল হক | সম্পাদনা : আব্দ আল-আহাদ
যখন ছোট ছিলাম, পৃথিবীটাকে মনে হতো
একেবারেই নির্ঝঞ্ঝাট এবং খুব পরিপাটি একটা
জায়গা। কিন্তু বড় হয়ে দেখলাম ব্যাপারটা
মোটেও সেরকম নয়। ভাবতাম সবকিছুই
ন্যায়নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ
আমার মনে হতো, কারও প্রতি কখনো কোনোরূপ
অন্যায় করা যাবে না। কোনো অন্যায় যদি হয়েই
যায়, তাহলে সকল ক্ষেত্রেই সুবিচারের জয়
হবে। নিজের এই নীতিবোধ অনুযায়ী, সবকিছু
যেমনটি হওয়া উচিত তেমনটি ঠিক রাখার
জন্য অনেক সংগ্রাম করেছি জীবনে। কিন্তু এই
সংগ্রাম করতে গিয়ে জীবনের একটি মৌলিক
সত্যকে উপেক্ষা করছিলাম আমি। আমার
শিশুসুলভ আদর্শবাদের কারণে আমি বুঝতেই
পারিনি, সৃষ্টিগতভাবেই এই পার্থিব জগতটা
ত্রুটিযুক্ত। ঠিক যেভাবে আমরা মানুষরা
সৃষ্টিগতভাবে অপূর্ণ, ত্রুটিযুক্ত। সবসময়
অঘটন আর ঝামেলা লেগেই থাকে আমাদের
জীবনে। এসব ঝামেলাই জড়িয়ে, জেনেই হোক,
না-জেনেই হোক, ইচ্ছা কি অনিচ্ছায় হোক,
অনিবার্যভাবেই আমরা মানুষের মনে কষ্ট দিয়ে
ফেলি। বাস্তব হলো, পৃথিবীটা সবসময়
ন্যায়নীতি দিয়ে চলে না।
তার মানে কি এই যে, আমরা অবিচারের বিরুদ্ধে
লড়াই থামিয়ে দেবো, সত্যের পক্ষে হাল ছেড়ে
দেবো? অবশ্যই না। এর মানে হলো, আমরা
অবশ্যই এই পৃথিবী এবং আর সবকিছুকে কোনো
কাল্পনিক বা অবাস্তব মানদণ্ডে বিচার করতে
যাবো না। তবে এমনটি না-করাও সহজ না।
কীভাবে আমরা এতো ত্রুটিময় এই পৃথিবীতে
টিকে থাকবো, যেখানে মানুষ প্রতিনিয়ত
পরস্পরকে হতাশায় ডুবাচ্ছে, এমনকি নিজ
পরিবারের লোকেরাই মনে আঘাত দিয়ে মনটা
ভেঙ্গে দিচ্ছে? সবচেয়ে কঠিন বিষয়টি হলো,
আমাদের প্রতি কেউ অন্যায় করলে কীভাবে
আমরা সেই অপরাধকে ক্ষমা করতে শিখব?
কীভাবে আমরা নিষ্ঠুর না হয়েও দৃঢ় হতে পারি?
অথবা কীভাবে দুর্বল না হয়েও মনের কোমলতাকে
বজায় রাখতে পারি? কখন আমরা কোনো কিছুকে
আঁকড়ে ধরে রাখবো? আর কখন সেটিকে বন্ধন
থেকে মুক্ত করে দেবো? কখন বেশি বেশি যত্ন
দেখালে তা বাড়াবাড়ি হয়ে যায়? কারও প্রতি
মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসা বলে কি কোনো
জিনিস আছে?
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদেরকে
প্রথমে নিজেরদের জীবনের গণ্ডি থেকে বের
হয়ে আসতে হবে। আমাদের খুঁজে দেখতে হবে,
আমরাই প্রথম বা শেষ কিনা, যারা কষ্ট এবং
অন্যায়ের শিকার। যে মানুষগুলো আমাদের আগে
পৃথিবীতে ছিল তাদের জীবনের দিকে দৃষ্টিপাত
করতে হবে। তাদের সংগ্রাম এবং তাদের বিজয়
নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা করতে হবে।
আমাদের বুঝতে হবে, কষ্ট ছাড়া কখনোই কোনো
অগ্রগতি আসেনি এবং সাফল্যের একমাত্র পথ
হলো সংগ্রাম। উপলব্ধি করতে হবে, জীবন
সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো কষ্টভোগ করা
এবং অন্যদের দেওয়া দুঃখকষ্ট এবং ক্ষতিকে জয়
করা।
আমাদের নবীদের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তসমূহ স্মরণ
করলে আমরা দেখতে পাই যে, দুঃখকষ্ট ভোগ করা
শুধু আমাদের জন্য কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
মনে রাখবেন, নূহ (আ) তাঁর জাতির লোকদের
দ্বারা ৯৫০ বছর ধরে অত্যাচারীত হয়েছিলেন।
কুরআন আমাদের বলে :
“তাদের পূর্বে নূহের সম্প্রদায়ও অস্বীকার
করেছিল। তারা আমার বান্দাকে অস্বীকার
করেছিল এবং এবং বলেছিল, ‘পাগল।’ আর তাকে
হুমকি দেওয়া হয়েছিল।”
[সূরা আল-কামার; ৫৪ : ৯]
নূহের (আ) উপর এত বেশী অত্যাচার করা
হয়েছিল যে:
“তিনি তার পালনকর্তাকে ডেকে বললেনঃ আমি
পরাভূত, অতএব, তুমি সাহায্য করো।” [আল-
কামার; ৫৪ : ১০]
নবীর (সা) কথাই মনে করে দেখুন, কীভাবে তাঁকে
পাথর মেরে রক্তাক্ত করা হয়েছিল। কীভাবে
তাঁর সাহাবীদের প্রহার করা হয়েছিল। কীভাবে
তারা অনাহারে দিন পার করেছিলেন। অন্য
মানুষরাই তাদেরকে এভাবে কষ্ট দিয়েছিল।
এমনকি আমরা অস্তিত্বে আসার পূর্বেই
ফেরেশতারা মানুষের এই ধরণের চারিত্রিক
দিকটি বুঝতে পেরেছিল। আল্লাহ্ যখন বললেন
যে, তিনি মানুষ সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন, তখন
ফেরেশতারা প্রথম যে প্রশ্নটি করেছিল তা
ছিল মানুষের ক্ষতিকর সম্ভাবনা সম্পর্কে।
আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন :
“আর স্মরণ করুন, যখন আপনার রব ফেরেশতাদের
বললেন : ‘নিশ্চয়ই আমি যমিনে একজন খলিফা
সৃষ্টি করছি’, তারা বলল, আপনি কি সেখানে
এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যে তাতে ফাসাদ
করবে এবং রক্ত প্রবাহিত করবে? আর আমরা তো
আপনার প্রশংসায় তাসবীহ্ পাঠ করছি এবং
আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। তিনি
বললেন, ‘নিশ্চয়ই আমি জানি যা তোমরা জানো
না।’ ” [আল-বাকারাহ্; ২ : ৩০]
মানুষ জাতির একে অপরের বিরুদ্ধে ঘৃণিত
অপরাধ সংঘটনের এই প্রবণতা একটি দুঃখজনক
বাস্তবতা। তবে আমাদের অনেকেই অনেক
সৌভাগ্যবান। আমাদের অধিকাংশকেই কখনো
এমন কোনো দুঃখকষ্টের শিকার হতে হয়নি
অন্যরা প্রতিনিয়তই যার শিকার হচ্ছে।
আমাদেরকে অনেককেই কোনোদিন নিজের চোখে
দেখতে হবে না যে, আমাদের পরিবার পরিজনের
কাউকে নির্যাতন করে খুন করা হচ্ছে।
তারপরও এমন মানুষ খুব কমই আছে, যারা বলতে
পারে, তারা কোনোদিনও কোনোভাবে অন্য কারও
দ্বারা কষ্ট পায়নি। সুতরাং, যদিও আমাদের
অনেকেই কোনোদিন জানবে না অনাহারে ক্ষুধার
যন্ত্রণায় মরার কষ্টটা কী; নিজের চোখের
সামনে নিজের বাড়িঘর ধ্বংস করতে দেখার
অনুভূতিটা কেমন, তথাপি আমার অনেকেই জানি
আহত হৃদয়ের কান্নার অনুভূতিটা কেমন।
আচ্ছা, এসব কি এড়ানো সম্ভব? আমার মনে হয়,
কিছুটা হলেও সম্ভব। আমরা কখনোই সকল
দুঃখকষ্টকে এড়াতে পারব না। তবে আমদের
প্রত্যাশা, আমাদের প্রতিক্রিয়া এবং আমাদের
মনোযোগকে পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে
নেওয়ার মাধ্যমে অনেক ধ্বংসযজ্ঞই এড়ানো
সম্ভব।
উদাহারনস্বরূপ বলা যায়, আমদের আশা, ভরসা,
বিশ্বাস — সবকিছুকে অন্য একজন মানুষের
উপর সমর্পণ করাটা একেবারেই অবস্তবিক এবং
ডাহা বোকামি। আমদের মনে রাখতে হবে, ভুল
করা মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাব। তাই আমাদের
চূড়ান্ত বিশ্বাস, আস্থা, এবং প্রত্যাশা শুধুমাত্র
আল্লাহ্র প্রতি সমর্পণ করা উচিত। আল্লাহ্
বলেন :
“যে ব্যক্তি তাগূতকে অস্বীকার করে এবং
আল্লাহ্র প্রতি ঈমান আনে, অবশ্যই সে মজবুত
রশি আঁকড়ে ধরে, যা ছিন্ন হবার নয়। আর
আল্লাহ্ সর্বশ্রোতা এবং সর্বজ্ঞ।” [আল-
বাকারাহ্; ২ : ২৫৬]
“আল্লাহ্র প্রতি ঈমান এমন মজবুত এক রশি
যা ছিন্ন হবার নয়।” — শুধু এই কথাটি যদি
আমরা স্মরণে রাখি, তাহলে অনেক
অনাকাঙ্ক্ষিত হতাশা থেকে মুক্তি পাওয়া
সম্ভব।
একথা বলার অর্থ কিন্তু এই নয় যে, আমরা
ভালোবাসবো না বা ভালোবাসলেও কম করে
বাসবো। তবে কীভাবে ভালোবাসবো সেটাই হলো
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকেই
বা কোনো কিছুকেই সর্বোচ্চ ভালোবাসা যাবে
না। অন্তরে আল্লাহ্ ব্যতীত আর কোনো
কিছুকেই অগ্রাধিকার দেওয়া যাবে না। আর
আল্লাহ্ ব্যতীত কোনো কিছুকেই এত বেশী
ভালোবাসা যাবে না যাতে করে ওই বস্তু ছাড়া
জীবন চলা আমাদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই
ধরনের “ভালোবাসা” ভালোবাসাই নয়। এটা এক
ধরনের পূজা করা। এই ভালোবাসায় কষ্ট ছাড়া
আর কিছু নেই।
তারপরও যদি কেউ এমন করে ভালোবাসে এবং
অন্যের দ্বারা আঘাত বা কষ্ট পায়, তাহলে
অনিবার্য পরিণতিটা কী দাঁড়ায়? সবচেয়ে
কঠিন কাজটা আমরা কীভাবে করতে পারি?
কীভাবে আমরা অন্যকে ক্ষমা করতে শিখব?
কীভাবে মনের ক্ষতগুলোকে সারিয়ে তুলে, তাদের
সাথে সদাচরণ বজায় রাখব যারা নিজেরাই
আমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করে না?
আবূ বাক্র (রা) এর ঘটনাটি ঠিক এমন
পরিস্থিতির একটি চমৎকার উদাহরণ। যখন
তাঁর মেয়ে, ‘আয়েশা (রা) সম্পর্কে জঘন্যতম
অপবাদ রটানো হলো, তিনি জানতে পারলেন,
এই অপবাদটা রটিয়েছিল মিস্তাহ্ নামে তারই
এক চাচাতো ভাই যাকে তিনি বহুদিন ধরে
আর্থিকভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে
আসছিলেন। সঙ্গত কারণেই আবূ বাক্র অপবাদ
আরোপকারীর সাহায্য বন্ধ করে দিলেন।
সামান্য সময় পরেই আল্লাহ্ নিম্নোক্ত আয়াত
অবতীর্ণ করলেন :
“আর তোমাদের মধ্যে যারা মর্যাদা ও
প্রাচুর্যের অধিকারী, তারা যেন এমন কসম না
করে যে, তারা নিকটাত্মীয়দের, মিসকীনদের
ও আল্লাহ্র পথে হিজরতকারীদেরকে কিছুই দেবে
না। আর তারা যেন তাদের ক্ষমা করে এবং তাদের
দোষক্রটি উপেক্ষা করে। তোমরা কি কামনা
করো না যে, আল্লাহ্ তোমাদের ক্ষমা করে দেন?
আর আল্লাহ্ বড়ই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [আন-
নূর; ২৪:২২]
এই আয়াত শুনেই আবূ বাক্র (রা) বুঝতে পারলেন
যে, তিনি নিজেই আল্লাহ্র ক্ষমা চান। তাই
তিনি শুধু সেই লোককে সাহায্য দেওয়া চালুই
করলেন না, এখন আগের চেয়ে বেশি করে দিতে
লাগলেন।
মু’মিন হওয়ার মূলেই হলো এইভাবে ক্ষমা করে
দেওয়া। এই ধরণের মু’মিনদের বর্ণনা দিয়ে
আল্লাহ্ বলেন :
“আর যারা গুরুতর পাপ ও অশ্লীল কার্যকলাপ
থেকে বেঁচে থাকে এবং যখন রাগান্বিত হয় তখন
তারা ক্ষমা করে দেয়।” [আশ-শূরা; ৪২:৩৭]
‘আমি নিজেও ভুল করি, অন্যদের কষ্ট দেয়’ —
নিজের সম্পর্কে এই ধরণের সচেতনতা বোধ
দ্বারা অন্যকে তাৎক্ষনিকভাবে ক্ষমা করে
দেওয়ার ক্ষমতাটা উদ্বুদ্ধ হওয়া উচিত।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই বিষয়টির মাধ্যমেই
আমাদের বিনম্রতা উজ্জীবিত হওয়া উচিত যে,
আমারা প্রতিদিন পাপ করার মাধ্যমে আল্লাহ্র
প্রতি অন্যায় করছি। আল্লাহ্র সাথে তুলনা
করলে মানুষ তো কিছুই না। তারপরও
বিশ্বজগতের প্রতিপালক, আল্লাহ্ আমাদের
প্রতিনিয়ত ক্ষমা করে দিচ্ছেন। তাহলে ক্ষমা
না করে মানুষকে বেঁধে রাখার আমরা কে? নিজেরা
যদি আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা পাওয়ার আশা করি,
তাহলে আমরা অন্যদেরকে ক্ষমা করতে পারি না
কেন? আর এ কারণেই নবী (সা) আমাদেরকে
শিক্ষা দিয়েছেন :
“যারা অন্যের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহ্ও
তাদের প্রতি দয়া করবেন না।” [মুসলিম;
অধ্যায় ৩০, হাদীস নং ৫৭৩৭]
আল্লাহ্র দয়া লাভের আশা যেন আমাদের অন্যদের
প্রতি দয়া করতে উদ্বুদ্ধ করে এবং একদিন সেই
দুনিয়ার নিয়ে যায় যা বাস্তবিক অর্থেই
নিখুঁত, ত্রুটিহীন, পরিপূর্ণ, অনুপম,
অতুলনীয়।

মৃত্যুর স্মরণ ও প্রস্তুতি

১ হযরত আবু হুরায়রা (রা) এর
রেওয়ায়েতে রাসুল (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেন,
হে মানব সম্প্রদায় ! সুখ বিনাশকারী
মৃত্যুকে বেশি বেশি করে স্মরণ করো।
– তিরমিযি,নাসায়ী, ইবন মাজাহ
২ হযরত আনাস (রা) এর বর্ণনায় রাসুল
(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
বলেন, সংকটময় মুহুর্তে বান্দা যখন
মৃত্যুকে স্মরণ করে তখ্ন এ স্মরণ তার
সংকটময়তাকে দূর করে দেয় আর সুখের
কালে মৃত্যু যখন স্মরণ করে তখন এ
স্মরণ তার সুখ স্বাচ্ছন্দকে তিরোহিত
করে দেয়।
৩ হযরত ওমর(রা) রেওয়ায়েত করেন,
রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম) কে জিজ্ঞেস করা হল, হে
আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম) ! সবচাইতে বুদ্ধিমান
লোক কে ? তিনি বললেন , যে ব্যক্তি
অধিকহারে মৃত্যুকে স্মরণ করে এবং
মৃত্যু পরবর্তী জীবনের প্রস্তুতি
গ্রহণে লেগে থাকে। (ইবন মাজাহ)
৪ হযরত শাদ্দাদ ইবন আউস(রা) এর
রেওয়ায়েতে রাসুল (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেন,
যে ব্যক্তি নিজের প্রবৃত্তিকে
শুধরিয়েছে এবং পারলৌকিক জীবনের
প্রস্তুতি স্বরুপ আমলে লেগে রয়েছে
সেই বুদ্ধিমান। আর যে ব্যক্তি
আকাঙ্ক্ষা রেখেছে আল্লাহর প্রতি
কিন্তু নিজেকে প্রবৃত্তির দাস
বানিয়েছে সে পরাজিত। -তিরমযি,ইবন
মাজাহ
৫ হযরত আবু হুরায়রা (রা) এর
রেওয়ায়েতে রাসুল (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেন,
মৃত্যুর পর সবাইকে আক্ষেপ করতে হবে।
সাহাবারা আরজ করলেন, সবাইকে আক্ষেপ
করতে হবে এর অর্থ কি হে আল্লাহর
রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম) ! তিনি বললেন, মৃত
ব্যক্তির পুণ্য যদি অল্প হয় তাহলে সে
এই বলে আক্ষেপ করবে যে আমি কেন
পুণ্য আরো বেশি করলাম না । আর যদি
সে পাপী হয় তাহলে পাপ থেকে বেঁচে না
থাকার কারণে আক্ষেপ করতে হবে।–
( তিরমিযি)
৬ হযরত রবি ইবন আনাস (রা) এর
রেওয়ায়েতে রাসুল (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেন,
পার্থিব জীবনের প্রতি অনাসক্তি ও
আখেরাতের প্রতি আসক্তি সৃষ্টির জন্যে
মৃত্যুর বিশ্বাস যথেষ্ট। – (আহমদ)
৭ হযরত আবু হুরায়রা (রা) এর
রেওয়ায়েতে রাসুল (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর দরবারে এক
ব্যক্তি হাজির হয়ে বলল, হে আল্লাহর
রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম) ! মৃত্যু যে আমার প্রিয় নয়।
রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন, তোমার
কাছে কি অর্থকড়ি আছে ? লোকটি
বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন এ্গুলো
অগ্রে প্রেরণ করে দাও। কেননা
মুমিনের হৃদয় তার সম্পদের সাথে লেগে
থাকে। তাই যদি সে সম্পদকে অগ্রে
প্রেরণ করে দেয় তাহলে তার আকাংখাও
হবে সম্পদের কাছে যেয়ে মিলিত
হবার। আর সম্পদ যদি পিছনে রেখে
যায় তাহলে সেও সম্পদের সাথে পিছে
থেকে যাবার আশা করবে। (আবু নায়ীম)
সম্পদ অগ্রে প্রেরণ করে দেয়ার অর্থ
হল, অভাবীদের মাঝে সেগুলো বন্টন
করে দেয়া।
৮ হযরত আবু কাতাদা (রা) ফরমান,
একবার রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম) এর সামনে দিয়ে একটি
জানাযার অতিক্রম হলো। রাসুল (সা)
এটি দেখে বললেন, ‘মুসতারিহ অথবা
মুসতারাহ মিনহু’। সাহাবারা আরজ
করলেন, হে আল্লাহর রাসুল
(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) !
মুসতারাহ এবং মুসতারাহ মিনহু এ
বাক্যের মর্মকথা কি ? রাসুল
(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
বললেন, মুমিন আল্লাহর রহমতের
মধ্যে প্রবেশ করে এবং দুনিয়ার যাতনা
ক্লেশ থেকে স্বস্তি পায়। আর পাপি ও
দুষ্ট লোকের মৃত্যুতে জীব-জানোয়ার,
বৃক্ষ লতা, স্থান অঞ্চল এবং
মানুষজনেরা স্বস্তি পায়। –
বুখারি,মুসলিম।
৯ হযরত ইবন মাসউদ(রা) বলেন,
আল্লাহর সাক্ষাতের মাঝেই মুমিনের
স্বস্তি। (আহমদ, ইবন আবি দুনিয়া)।
১০ হযরত মাইমুন ইবন মেহরান(রা)
বর্ণনা করেন, তোমরা সৎ কর্মের মাঝে
লেগে থাকো, অথবা পূর্বে যে সৎ কাজ
করেছ সেগুলোর স্মরন অব্যাহত রাখো।
কারণ এতে মৃত্যু্র সময় সহজে আত্মা
বেরিয়ে আসবে। (আহমদ)

খাবার খাওয়ার নিয়ম

ইসলামে খাবার গ্রহণের আদব
ﺪﻤﺤﻟﺍ ﻪﻠﻟ ﺏﺭ ،ﻦﻴﻤﻟﺎﻌﻟﺍ ﻰﻠﺻﻭ
ﻪﻠﻟﺍ ﻢﻠﺳﻭ ﻙﺭﺎﺑﻭ ﺎﻨﻴﺒﻧ ﻰﻠﻋ ٍﺪﻤﺤﻣ
ﻰﻠﻋﻭ ﻪﻟﺁ ﺪﻌﺑﻭ .ﻦﻴﻌﻤﺟﺃ ﻪﺒﺤﺻﻭ :
বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে খাবার গ্রহণের আদব
বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই। কেননা খাওয়া-
দাওয়া আমাদের প্রাত্যহিক বিষয়। তাই এ
বিষয়ের আদব ভাল করে রপ্ত করাও জরুরি।
উলামগণ এ বিষয়টিকে বিশ্লিষ্ট আকারে
বর্ণনা করেছেন। ব্যাখ্যা করেছেন বিভিন্ন
দৃষ্টিকোণ থেকে। কেননা এ বিষয়ে বহু
হাদীস, ও শরয়ী টেক্সট রয়েছে। শরীয়ত
মানবজীবনের সকল দিককেই যথার্থরূপে
গুরুত্ব দিয়েছে। উপরন্তু যে দিকটি
মুসলমানের জীবনে বেশি উপস্থিত সে
দিকটির উপর শরীয়তের গুরুত্ব প্রদানের
মাত্রাও সমানুপাতিক হারে অধিক।
• খাদ্য বিষয়ক অথবা খাবার গ্রহণের
আদব অনেক; খাবার গ্রহণের আদবের মধ্যে
হল:
এক: খাবার গ্রহণের পূর্বে হাত ধৌত করা।
নাসায়ী শরীফের একটি সহীহ হাদীসে
এসেছে,
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম ‘ যখন
জুনুব (স্বামী-স্ত্রী মিলনজনিত অপবিত্র)
অবস্থায় ঘুমাতে যেতেন তখন তিনি ওজু করে
নিতেন। আর যখন তিনি খাবার গ্রহণের
ইচ্ছা করতেন তখন হাত ধুয়ে নিতেন।)
হাদীসটি আলোচ্য মাসআলার ক্ষেত্রে খুবই
গুরুত্বপূর্ণ।
দুই: খাবার গ্রহণের পূর্বে আল্লাহর নাম
নেয়া। এ সম্পর্কে অনেক হাদীস এসেছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেছেন,
‘ হে বালক! আল্লাহর নাম নাও’ ( অর্থাৎ
বিসমিল্লাহ বল)
বরং আরো স্পষ্ট ভাষায় এভাবে এসেছে :
( হে বালক! যখন তুমি খাবার গ্রহণ করতে
ইচ্ছা করবে, বল, বিসমিল্লাহ।
তিন: ডান হাত দিয়ে খাবার গ্রহণ করা।
হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
( ডান হাত দিয়ে খাও)
চার: খাবারের নিকটবর্তী হয়ে খাবার গ্রহণ
করা, হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
হে বৎস! কাছে এসো’।
পাঁচ: খাবার গ্রহণকারী তার কাছের অংশ
থেকে খাবে, হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
(তোমার কাছের অংশ থেকে খাও)
ছয়: বিচ্ছিন্নভাবে নয় বরং সম্মিলিতভাবে
খাবার গ্রহণ করা, হাদীসে এসেছে,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেছেন,
(তোমরা জমায়েত হয়ে খাবার গ্রহণ কর, তাতে
আল্লাহর নাম স্মরণ কর। খাবারে তোমাদেরকে
বরকত দেয়া হবে)
জমায়েত হয়ে খাবার গ্রহণের একটি ফল এই
যে এ অবস্থায় একজনের খাবার দু’জনের জন্য
যথেষ্ট হয়ে যায়, আর দু’জনেরটা তিনজন বা
চারজনের জন্য। আর চারজনেরটা পাঁচ অথবা
ছয়জনের জন্য। হাদীসটি বিশুদ্ধ এবং ইবনে
মাজায় বর্ণিত হয়েছে।
সাত ও আট: খাবার শেষে রুমাল অথবা অন্যকিছু
দিয়ে হাত না মুছা যতক্ষণ না তা চেটে অথবা
চাটিয়ে পরিচ্ছন করা হবে।
নাসায়ী শরীফের সহীহ হাদীসে এসেছে,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেছেন,
(তোমাদের মধ্যে কেউ যখন খাবার খাবে, সে
যেন তার হাত না মুছে যতক্ষণ না সে তা চেটে
অথবা অন্যকে দিয়ে চাটিয়ে নেয়। আর থালা
যেন উঠিয়ে না নেয় যতক্ষণ না তা লেহন করা
হবে; কেননা খাবারের শেষ অংশটায় বরকত
রয়েছে।)
এটা হল খাবারের আট নম্বর আদব। অর্থাৎ
থালা লেহন করে খাবারের শেষ অংশের বরকত
নেওয়া।
নয়: খাবারের লোকমা পড়ে গেলে তা পরিত্যাগ
না করা; কেননা হাদীসে রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
(যখন তোমাদের কেউ খাবার খায় এবং তার হাত
থেকে লোকমা পড়ে যায়, তাহলে যে অংশে (ময়লা
লেগেছে বলে) সন্দেহ হয় তা সরিয়ে ফেলবে,
এবং ভক্ষণ করবে। শয়তানের জন্য ফেলে
রাখবে না।)
দশ: সদ্য রান্না করা খাবারের ধোঁয়া নিঃশেষ
হয়ে স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা;
হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
( ওটা অধিক বরকতের কারণ)
এগার: খাবারে ফুৎকার না করা, খাবারে
ফুৎকারের হয়ত ক্ষতির দিক রয়েছে যা
আমাদের জানা নেই।
বার: এক পার্শ্ব থেকে খাবার খাওয়া; হাদীসে
এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
( তোমরা খাবারের পার্শ্ব থেকে খাও, মধ্যভাগ
ছেড়ে দাও, ওতে তোমাদেরকে বরকত দেওয়া
হবে।)
অন্য এক হাদীসে তিনি বলেছেন,
( বিসমিল্লাহ বলে খাবারের পার্শ্ব থেকে
খাও, তার প্রধান অংশ ছেড়ে দাও; কেননা
খাবারের বরকত উপর দিক থেকে আসে।)
তিনি আরো বলেছেন,
( বরকত, পাত্রের মধ্যখানে, অতঃপর তোমরা
পার্শ্ব থেকে খাও, প্রধান অংশ থেকে খেয়ো
না।)
তের: মাটিতে বসে খাওয়া; কেননা রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
(একজন দাস যেভাবে খায় আমিও সেভাবে খাই,
একজন দাস যেভাবে বসে আমিও সেভাবে বসি;
আর আমি তো দাস ভিন্ন অন্য কিছু নই।)
অন্য এক হাদীসে বলেছেন,
(একজন দাস যেভাবে খারার খায় আমিও সেভাবে
খাবার খাই, আমার আত্মা যার হাতে তার কসম,
দুনিয়া যদি আল্লাহর কাছে একটি মাছির
পাখা পরিমাণ ওজনসম্পন্ন হত, তাহলে
কোনো কাফেরকে তিনি এক ঢোক পানিও খেতে
দিতেন না।)
চৌদ্দ: খাদেম যখন পরিবেশনের জন্য খাবার
নিয়ে আসে তখন তাকে ওই খাবার থেকে কিছু
দেয়া; কেননা বিশুদ্ধ হাদীসে এসেছে,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেছেন,
(যখন কারও কাছে তার খাদেম- যে খাবার
তৈরি ও ধোঁয়ার কষ্ট সয়েছে- খাবার নিয়ে
আসবে সে যেন তাকে তার সঙ্গেই বসায়, আর
যদি না বসায় তাহলে যেন এক লোকমা বা দুই
লোকমা তাকে দেয়।)
এতে একদিকে রন্ধনকারী খাদেম, যে খাবার
পাকাতে শ্রম দিয়েছে, ধোঁয়া আগুনের তাপ
ইত্যাদি সহ্য করেছে, তাকে সাথে বসিয়ে
পুরস্কৃত করার আদর্শ পাওয়া যাচ্ছে, অন্য
দিকে তাওয়াজু ও বিনম্রতারও একটি দিক
রয়েছে।
পনের: খাবার পছন্দ না হলে উহ্ আহ্ না করা,
বিরক্তিভাব প্রকাশ না করা, বরং কেবল
গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা। হাদীসে
এসেছে,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেছেন,
(যদি তার মনঃপূত হয় খাবে, অন্যথায় রেখে
দিবে।)
অন্য এক হাদীসে এসেছে,
(নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে
যখন গুইসাব খেতে দেয়া হল, তিনি তা রেখে
দিলেন এবং বললেন, এটা আমার কাওমের
এলাকায় নেই। তাই এতে আগ্রহ পাচ্ছি না।)
ষোল: খেজুরে কোনো পোকা আছে কি-না তা দেখে
নেয়া। আবু দাউদ শরীফের একটি সহীহ
হাদীসে এসেছে,
(আনাস রা. থেকে বর্ণিত যে রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে
পোকাবিশিষ্ট খেজুর নিয়ে আসা হত, অতঃপর
তিনি তা তালাশ করে বের করতেন)
সতের: খাবারের পরে দোআ পড়া। হাদীসে অনেক
দোআর কথা এসেছে, তন্মধ্যে একটি হল,
(আলহামদু লিল্লাহ) বলা।
আঠার: কেউ যখন গোশ্ত পাকাবে তার উচিত
হবে ঝোল বাড়িয়ে দেয়া, এবং তা থেকে
প্রতিবেশীকে দেয়া। হাদীসে এসেছে,
(তোমরা যখন গোশ্ত পাকাবে, তাতে ঝোল
বাড়িয়ে দেবে, প্রতিবেশীর ক্ষেত্রে এটা
একটা বদান্যতা।)
তিনি আরো বলেছেন,
(তোমাদের মধ্যে যখন কেউ পাতিলে রান্না
করবে, সে যেন তার ঝোল বাড়িয়ে দেয়, এবং তা
থেকে প্রতিবেশীকে দেয়।)
অর্থাৎ খাবার ও ঝোল উভয়টাই।
ঊনিশ: খাবারে মাছি পড়ে গেলে করণীয় কী ?
এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম থেকে একটি আদব আমরা জানতে
পারি, আর তা হল, হাদীসে এসেছে যে,
(তোমাদের কারও পাত্রে মাছি পড়ে গেলে সে
যেন তা ডুবিয়ে দেয়, কেননা ওর এক ডানায়
রোগ ও অন্য ডানায় শেফা রয়েছে। মাছির যে
ডানায় রোগ সেটা দিয়ে সে প্রতিরোধ করে।)
অন্য এক বর্ণায় এসেছে,
(আর মাছি বিষটাকে এগিয়ে দেয়, শেফাটাকে
পিছিয়ে রাখে, অতঃপর ওর পুরোটা ডুবিয়ে
দিলে তা চলে যায়)
বিশ: বিরক্তিকর উচ্চ আওয়াজে খাবার না
চিবানো, হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
( তোমার এই বিরক্তিকর উচ্চ আওয়াজ বন্ধ
কর)
অন্য বর্ণনায় এসেছে,
( তোমার এই বিরক্তিকর উচ্চ আওয়াজ হতে
বারণ হও।)
একুশ: হাত ধুয়ে পরিষ্কার করা, বিশেষ করে
ঘুমানোর পূর্বে, হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
(তোমাদের মধ্যে যখন কেউ ঘুমাতে যাবে আর
তার হাতে খাবারের গন্ধ রয়েছে- যেমন গোশ্ত,
চর্বি ইত্যাদির গন্ধ- সে যেন তা ধুয়ে নেয়,
অন্যথায় কোনো কিছু হলে তার দায়িত্ব
তাকেই বহন করতে হবে।)
বাইশ: রাতের খাবার রাখা হলে এশার সালাতের
সময় হয়ে গেলে প্রথমে খাবার খেয়ে নেবে,
খাবার রেখে তাড়াহুড়া করবে না।
তেইশ: খাবার গ্রহণের সময় বসার পদ্ধতির
প্রতি নজর দেয়া জরুরি। ডান পা দাঁড় করিয়ে
বাঁ পায়ের উপর বসতে হবে। অথবা উবু হয়ে
বসবে। হেলান দিয়ে বসবে না। কেননা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেছেন,
( আর আমি, আমি তো হেলান দিয়ে খাই না।)
চব্বিশ: আর পেটের উপর শুয়ে খাবে না। কেননা
হাদীসে এভাবে খাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা
এসেছে।
পঁচিশ: পূর্ণরূপে তৃপ্ত না হওয়া; হাদীসে
এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
একতৃতীয়াংশ খাবারের জন্য, একতৃতীয়াংশ
পানীয়ের জন্য, আরেক তৃতীয়াংশ নিজের
জন্য। বনি আদমের তো মাত্র কয়েক লোকমাই
যথেষ্ট যা তার মেরুদণ্ড সোজা রাখবে।
রকমারি খাবার ও পানীয়ে অপচয়কে তিনি
নিন্দা করেছেন।
ছাব্বিশ: তিন আঙ্গুল দিয়ে খাবার গ্রহণ
করা; হাদীসে এসেছে,
(রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম তিন আঙ্গুল দিয়ে খেতেন। আর
তিনি যখন খাবার খেতেন, তিনি তাঁর আঙ্গুল
তিনটি চেটে খেতেন।
সাতাশ: অন্য কারও সাথে খাওয়ার সময় দুই
খেজুর অথবা এ জাতীয় খাবার একসাথে না
নেয়া। হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম ‘ইকরান’ তথা দু’ খেজুর একসাথে
নেয়াকে নিষেধ করেছেন। ইকরান হল দুই
অথবা ততোধিক খেজুর, ফল ইত্যাদি যা হিসেব
করা যায়, এগুলোর মধ্যে দুটি একসাথে উঠিয়ে
নেয়া অনুচিত। তবে যদি তার সাথী অনুমতি
দেয় সে ক্ষেত্রে অন্য কথা। হাদীসে এসেছে,
( তবে যদি ব্যক্তি তার ভাইয়ের কাছে অনুমতি
চায়।)
আটাশ: হারাম খাবারবিশিষ্ট দস্তরখানে না
বসা। এটা অবশ্য আদব নয় বরং বিধান।
হাদীসে এসেছে,
(রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম এমন দস্তরখানে বসতে নিষেধ
করেছেন যেখানে মদ্যপান করা হয়।)
ঊনত্রিশ: খাবারের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা
করা, এমনকী খাবারের ধরন-ধারণের
ক্ষেত্রেও,
এর প্রমাণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত হাদীস,
( রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম তরমুজের সাথে তাজা খেজুর
খেতেন, এবং বলতেন, (আমি এটার তপ্ততা
ওটার শীতলতা দিয়ে দমন করি। আর ওটার
শীতলতা এটার তপ্ততা দিয়ে দমন করি।)
এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামের খাবারের প্রকার ও
ধরনে ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টি নির্দেশ
করছে।
তিরিশ: পিঁয়াজ, রসুন, এবং লীক (গন্ধে ও
স্বাদে পিঁয়াজের মতো সবজি) খাওয়ার পর
মসজিদে না যাওয়া।
একত্রিশ: ইসলামী শরীয়ত যেসব খাবারের
ফজিলত বর্ণনা করেছে সে সবের প্রতি
গুরুত্বারোপ করা। হাদীসে এসেছে,
(যে বাড়িতে খেজুর নেই সে বাড়িতে যেন
খাবারই নেই।)
অন্য এক হাদীসে এসেছে,
(যে বাড়িতে খেজুর নেই সে বাড়ীর লোকজন
ক্ষুধার্ত।
আরেক হাদীসে এসেছে,
( তোমরা তেল খাও ও শরীরে ব্যবহার কর।)
অর্থাৎ খাবার হিসেবে খেজুরের প্রতি গুরুত্ব
এসেছে, যাইতুনের তেল (ওলিভ ওয়েল) এর
প্রতি গুরুত্ব এসেছে। তদ্রুপভাবে সিরকা
(ভিনেগার) এর প্রতিও গুরুত্ব এসেছে।
হাদীসে এসেছে,
(সিরকা, সুন্দর এক ব্যঞ্জন।)
এগুলোকে প্রাধান্য দেওয়ার পর যার যার
পছন্দতম হালাল খাদ্য খাবে। উদাহরণত,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
রান ও কদু পছন্দ করতেন।
খাবার বিষয়ে যত্ন সম্পর্কে আরো বলা যায়
যে ইসলামী শরীয়ত রুটিকে সম্মান করতে
বলেছে। সে হিসেবে রুটি যেখানে সেখানে ফেলে
দেওয়া, রুটির সাথে তাচ্ছিল্যপূর্ণ আচরণ
করা উচিত হবে না। হাদীসে এসেছে,
( তোমরা রুটিকে সম্মান কর।)
তবে রুটি চাকু দিয়ে কাটা যাবে না এমন কোনো
কথা আসে নি। রুটিকে কেবল সম্মান করতেই
বলা হয়েছে। এ কারণে রুটি ফেলে দেয়া যাবে
না। যদি কেউ তা দেখে তবে অন্য খাবারের
তুলনায় বেশি গুরুত্ব দেবে। সে হিসেবে
মাটিতে ফেলে রাখা অবস্থায় যদি কেউ কোন
রুটি পায় তবে তা উঠিয়ে উঁচু জায়গায় রাখবে,
অথবা জন্তু ইত্যাদিকে খাওয়াবে।
খাবারের আদব ও তার কিছু আহকাম সম্পর্কে
এখানে আলোচনা করলাম। ওলিমা, দাওয়াত ও
মেহমানদারি সম্পর্কেও আদব আহকাম রয়েছে,
উদাহরণত দাওয়াতকারী মুসলমান হলে, সে
খাবার কোথা হতে পেল, অথবা কোত্থেকে ক্রয়
করেছে ইত্যাদি প্রশ্ন না করা।
সমাপ্ত
লেখক: মুহাম্মাদ সালেহ আল মুনাজ্জিদ
অনুবাদক: আবু শুআইব মুহাম্মাদ সিদ্দীক
সূত্র: ইসলামহাউজ

শবে বরাত পালন

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
প্রিয় ভাই, আর কয়দিন পরেই পালিত হবে শবে
বরাত। সে দিন সরকারী ছুটি ঘোষণা করা
হবে। হালুয়া-রুটি খাওয়ার ধুম পড়ে যাবে।
অনুষ্ঠিত হবে মিলাদ মাহফিল ও জিকিরের
মজলিস। সেই সাথে মুর্হুমূহু আতশবাজিতে কেঁপে
কেঁপে উঠবে শবে বরাতের রাতের আকাশ। আরও
দেখা যাবে মসজিদের আঙ্গিনাতে যাদের পদ
যুগল
পড়ত না সে রাতে তারাই আতর-সুগন্ধি মেখে
টুপি-পাঞ্জাবী পরে মসজিদের প্রথম কাতারে
মুসল্লী সেজে অবস্থান করছে আর বিশেষ কিছু
এবাদত-বন্দেগী করে মনে করবে জীবনের সব
গুনাহ মাফ হয়ে গেছে। তারপর দিন সকাল থেকে
লিপ্ত হবে যাবতীয় অন্যায়-অপকর্ম, দুর্নীতি
আর আল্লাহর নাফরমানীতে। হয়ত সে দিনকার
ফজরের নামায পড়ারও সময় হবে না। আর
অপেক্ষায় থাকবে আগামী বছর শবে বরাতের।
এভাবে আরও কত কি? আমাদের সমাজের এ
অবস্থায় আমরা জানার চেষ্টা করি একাজগুলো
কতটুকু ইসলাম সমর্থিত?
যে সকল ইবাদতের ক্ষেত্রে ইসলাম সমর্থন দেয়
নি সেটা ইসলামের নামে করাই তো বিদআত।
বিদআতের পরিণাম অতি ভয়ানক। এ ব্যাপারে
কুরআনও হাদীসে অসংখ্য সতর্কতা উচ্চারিত
হয়েছে। তাই আসুন, আমরা নিজেরা বিদআত থেকে
বাঁচি সেই সাথে বাঁচানোর চেষ্টা করি আমাদের
সমাজকে। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দান
করুন।
আমাদের সমাজে শবে বরাত উপলক্ষে প্রচলিত
কতিপয় বিদআতের উদাহরণ:
১) শবে বরাত উপলক্ষে ১৪ শাবান দিনে রোযা
রাখা এবং ১৪ তারিখ দিবাগত রাত ১৫ শাবানে
একশত নামায আদায় করা:
এ রাতে এক অদ্ভূত পদ্ধতিতে একশত রাকাআত
নামায আদায় করা হয়। যাকে বলা হয় সালাতুল
আলাফিয়া। একশত রাকাআত নামায পড়ার
পদ্ধতিটি হল নিম্নরূপ:
মোট একশত রাকাআত নামায পড়তে হয়। প্রতি
দু রাকাত পর সালাম ফিরাতে হবে। প্রতি
রাকাআতে সূরা ফাতিহার পর দশ বার সূরা
ইখলাস পাঠ করতে হবে। একশত রাকাআত নামাযে
সূরা ইখলাস পাঠ করতে হয় মোট এক হাজার
বার। তাই এ নামাযকে সালাতে আলফিয়া বলা
হয়।
শবে বরাতে একশত রাকাআত নামায পড়ার
বিধান:
ইসলামে এ ধরণের নামায পড়ার নিয়ম সম্পূর্ণ
নতুন আবিস্কৃত বিদআত। এ ব্যাপারে সর্ব যুগের
সমস্ত আলেমগণ একমত। কারণ, তা রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং
খোলাফায়ে রাশেদীন কখনো তা পড়েন নি।
তাছাড়া ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম
শাফেঈ, আহমদ বিন হাম্বল, সুফিয়ান সাওরী,
আওযাঈ, লাইস প্রমূখ যুগ শ্রেষ্ঠ ইমামগণ কেউ
এ ধরণের বিশেষ নামায পড়ার কথা বলেন নি।
এ সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসটি হাদীস
বিশেষজ্ঞদের মতে বানোয়াট এবং জাল। যেমন,
ইব্নুল জাওযী উক্ত হাদীসটি মাওযু’আত (জাল
হাদীস সংগ্রহ) কিতাবে তিনটি সনদে উল্লেখ
করে বলেছেন, এটি যে বানোয়াট তাতে কোন
সন্দেহ নেই। তিনটি সনদেই এমন সব
বর্ণনাকারী রয়েছে যাদের অধিাকংশরই
পরিচয় অজ্ঞাত। আরো কতিপয় বর্ণনাকারী
খুব দূর্বল। সুতরাং হাদীসটি নিশ্চিতভাবে
জাল।
এ নামায কে কখন কীভাবে চালু করল?
ইমাম ত্বরতূশী (রাহ) বলেন: শাবান মাসের
পনের তারিখ রাতে একশত রাকআত নামায পড়ার
পদ্ধতি সর্ব প্রথম যে ব্যক্তি চালু করে তার
নাম হল ইব্ন আবুল হামরা। তিনি ছিলেন
ফিলিস্তিনের নাবলুস শহরের অধিবাসী।
তিনি ৪৪৮ হিজরী সনে বাইতুল মাকদিসে
আসেন। তার তেলাওয়াত ছিল খুব সুন্দর। তিনি
শাবান মাসের পনের তারিখ রাতে মসজিদুল
আকসায় এসে নামায শুরু করে। আর এক লোক তার
পেছনে এক্তেদা করে। অতঃপর আর একজন আসে।
কিছুক্ষণপর আরে আরও একজন। এভাবে নামায
শেষে দেখা গেল বিরাট জামাআতে পরিণত
হয়েছে।
পরিবর্তী বছর শবে বরাতে সে ব্যক্তির সাথে
প্রচুর পরিমাণ মানুষ নামাযে শরীক হয়।
এভাবে এ নামাযটি মসজিদে আক্বসা সহ
বিভিন্ন মসজিদে পড়া আরম্ভ হয়ে গেল। কিছু
মানুষ নিজেদের বাড়িতে এ নামায পড়া শুরু করে
দিল। পরিশেষে এমন অবস্থা দাঁড়ালো যেন এটি
একটি সুন্নাত।
অনুরূপভাবে শুধু চৌদ্দ তারিখ দিনে রোযা
রাখাও বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়। বরং
আল্লাহর নবীর সুন্নত হল, শাবান মাসের
প্রথম থেকেই বেশি বেশি নফল রোযা রাখা।
বিশেষভাবে ঐ দিন রোযা রাখার কোন ভিত্তি
নাই।
২) হালুয়া-রুটি খাওয়া: শবে বরাত উপলক্ষ্যে
ঘরে ঘরে হালওয়া-রুটি খাওয়ার হিড়িক পড়ে
যায়। শুধু তাই নয় বরং সে দিন গরীব মানুষও
টাকা হাওলত করে হলেও এক বেলা গোস্ত কিনে
খায়। কারণ, সে দিন যদি ভাল খাবার খাওয়া
যায় তাহলে নাকি সারা বছর ভাল খাবার খাওয়া
যাবে। আর হালওয়া-রুটি খাওয়ার কারণ হিসেবে
বলা হয়, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম ওহুদ যুদ্ধে দাঁত ভাঙ্গার পর শক্ত
খাবার খেতে পারেন নি। তাই তাঁর প্রতি
সমবেদনা জানানোর উদ্দেশ্যে এ দিন ঘটা করে
হালওয়া রুটি খাওয়া হয়।
কিন্তু বাস্তবতা কি তাই?
প্রথমত: আমরা জানি ওহুদের এক রক্তক্ষয়ী ও
অসম যুদ্ধে কাফেরদের আঘাতে নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁত ভেঙ্গে দিয়ে ছিল।
কিন্তু তা শাবান মাসে তো ওহুদ যুদ্ধ হয় নি।
বরং তা হয়েছিল ২য় হিজরী শাওয়াল মাসের
সাত তারিখে। তাহলে এ সমবেদনা শাবান মাসের
পনের তারিখে কি কিভাবে করা হয়?
২য়ত: হল, তিনি নরম খাবার কি শুধু একদিন
খেয়ে ছিলেন? তাহলে এ কেমন ভালবাসা? আপনি
শাবান মাসের পনের তারিখে কিছু হালওয়া-রুটি
খেলেন আবার কিছুক্ষণ পর গরুর গোস্ত তো
ঠিকই চাবিয়ে চাবিয়ে ভক্ষণ করতে থাকেন??
৩য়ত: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম
তো কাফেরদের সাথে এক কঠিন রক্তক্ষয়ী
যুদ্ধে বীরে মত যুদ্ধ করে তার পবিত্র দাঁত
হারিয়েছেন কিন’ আমাদের এসব নবী ভক্তের
অধিকাংশের অবস্থা হল, আল্লাহর নবীর রেখে
যাওয়া সাধারণ সুন্নতগুলোও পালন করে না।
অনেকে তো ফরজ নামাযই ঠিকমত আদায় করে
না। এটাই হল এদের তথাকথিত ভালবাসার
নুমনা।
৩) ছবি ও মূর্তি তৈরি: শবে বরাত উপলক্ষ্যে
দেখা যায় নানা রং বেরঙ্গের ছবি ও মূর্তি
তৈরি কৃত মিষ্টান্নতে বাজার ছেয়ে যায়। অথচ
ছবি ও মূর্তি-প্রকৃতি ইত্যাদি তৈরি করা
ইসলামে হারাম। আবার আল্লাহর দেয়া রিযিক
নিয়ে এভাবে খেল-তামাশা?!
৪) মীলাদ ও যিকির: শবে বরাত উপলক্ষ্যে
মসজিদ, খানকাহ ও দরগায় সমূহে শুরু হয়
মীলাদ মাহফিল। চলে মিষ্টি খওয়ার ধুম।
চলতে থাকে বিদআতী পন্থায় গরম যিকিরের
মজলিশ। এ সব কাজ দ্বীনের মধ্যে বিদআত
ছাড়া কিছু নয়।
৫) কবর যিয়ারত: এক শ্রেণীর মানুষ এ রাতে
গোরস্থান বা মাযার জিয়ারতে বের হয়।
এমনকি কোথাও কোথাও এ প্রথাও দেখা যায় যে,
একদল মানুষ এ রাতে ধারাবাহিকভাবে এলাকার
সকল কবর যিয়ারত করে থাকে। এদের দলীল
হল, শাবান মাসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম এর বাকী গোরস্থা যিয়ারতের
হাদীস অথচ মুহাদ্দসিগণ উক্ত হাদীসটি জাল
হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। যেমনটি পূর্বে
আলোচনা করেছি।
৬) আলোক সজ্জা করা এবং আতশবাজী করা : শবে
বরাত উপলক্ষ্যে রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি,
মসজিদ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি
আলোকসজ্জা করা হয়। সে রাতে আশ্চর্য
জনকভাবে চলতে থাকে আতশবাজী বা পটকা
ফুটানো। মূলত: এসব কাজের মাধ্যমে একদিকে
লক্ষ লক্ষ টাকা শুধু অপচয় করা হয় না বরং
এগুলো অগ্নি পুজকদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
৭) মৃতদের আত্মার দুনিয়াতের পূণরাগমনের
বিশ্বাস: এ উপলক্ষ্যে দেখা যায় মহিলাগণ
ঘর-বাড়ি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে আতর
সুগন্ধি লাগিয়ে পরিপাটি করে রাখে। বিশেষ
করে বিধবা মহিলাগণ এমনটি করেন। এমনকি
তারা কিছু খাবার একটুকরো কাপড়ে পুরে ঘরে
ঝুলিয়ে রাখে। কারণ, তাদের বিশ্বাস হল,
তাদের মৃত স্বামী-স্বজনদের আত্মা এ রাতে ছাড়া
পেয়ে নিজ নিজ পরিবারের সাথে দেখা করতে
আসে। এটা যে কতবড় মূর্খতা তা একমাত্র
আল্লাহ জানেন।
মানুষ মারা গেলে তাদের আত্মা বছরের কোন
একটি সময় আবার দুনিয়াতে ফিরে আসা
মুসলমানদের আকীদাহ নয়। বরং অনেকটা তা
হিন্দুয়ানী আকীদার সাথে সাঞ্জস্যপূর্ণ।